শুভ বাংলা নববর্ষ ১৪২৮ || Happy Bengali New Year 1428
সবাইকে বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা
যেভাবে শুরু
বাংলা সনের শুরু নিয়ে মোটা দাগে ২ টি মত চালু আছে।
এর একটি মত হল - প্রাচীন বঙ্গদেশের রাজা শশাঙ্ক বাংলা সন মানে বঙ্গাব্দ চালু করেছিলেন। শশাঙ্কের রাজত্বকাল ছিল আনুমানিক ৫৯০-৬২৫ খ্রিস্টাব্দ। এখনকার বাংলা, বিহার ছিল শশাঙ্কের সম্রাজ্যভূক্ত এলাকা । ধারণা করা হয় জুলীয় পঞ্জিকার ৫৯৪ সনের ১৮ মার্চ বৃহস্পতিবার এবং গ্রেগরীয় পঞ্জিকার ৫৯৪ সনের ২০ মার্চ শনিবার বাংলা সন বা বঙ্গাব্দের শুরু হয়েছিল।
বাংলা সন প্রবর্তনের অপর মত অনুসারে, ইসলামী শাসনামলে প্রচলিত চান্দ্র মাসের উপর নির্ভরশীল হিজরী পঞ্জিকায় বছরে দিনের সংখ্যা সৌর বছরের চেয়ে ১১/১২ দিন কম হয়। অর্থ্যাৎ সৌর বছর যেখানে ৩৬৫ দিন, চান্দ্র বছর সেখানে ৩৫৪ দিন, যার ফলে চান্দ্র বছরে ঋতুগুলি ঠিক থাকে না। কারণ ঋতু সূর্যের উপর নির্ভরশীল, চাঁদের উপর নয়। আর বঙ্গদেশের চাষাবাদ ও এ জাতীয় অনেক কাজ ঋতুনির্ভর । একারনে মোগল সম্রাট আকবর বিশিষ্ট ইরানী জ্যোতির্বিজ্ঞানী আমির ফতুল্লাহ শিরাজীকে হিজরী চান্দ্র বর্ষপঞ্জিকে সৌর বর্ষপঞ্জিতে রূপান্তরিত করার দায়িত্ব প্রদান করেন। ফার্সি বর্ষপঞ্জি অনুকরণে ফতুল্লাহ শিরাজী যে বর্ষপঞ্জি তৈরি করেন, সম্রাট আকবর ৯৯২ হিজরী সনে অর্থ্যাৎ ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দে সে অনুযায়ী হিজরী সৌর বর্ষপঞ্জি প্রবর্তন করেন। যদিও সেটি ৯৯২ হিজরী সনে প্রথম প্রচলন শুরু হয় তবে সম্রাট আকবর তা তার সিংহাসনে আরোহনের বছর অর্থ্যাৎ ৯৬৩ সাল থেকে গণনা শুরু করার নির্দেশ দেন। হিজরী পঞ্জিকা অনুসারে বছরের প্রথম মাস মুহররম, ৯৬৩ হিজরী সালের মুহররম মাস ছিল বাংলা বৈশাখ মাস, সেকারনেই বৈশাখ মাসকেই বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস এবং ১লা বৈশাখকে নববর্ষ ধরা হয়।
তবে শামসুজ্জামান খান এবং নিতীশ সেনগুপ্তের মতো আরো অনেকের মতে বাংলা বর্ষপঞ্জির উৎপত্তি পরিষ্কার নয়। এর উৎপত্তিতে ধর্মীয় প্রভাব থাকতে পারে যেমন ইসলামী প্রভাব ও বৌদ্ধ বা হিন্দু প্রভাব ।
ইসলামী প্রভাব
শামসুজ্জামান খান মনে করেন, বাংলা সন ও সাল হল যথাক্রমে আরবী ও ফারসী শব্দ যা মুসলিম রাজা বা সুলতান কর্তৃক বাংলায় পরিচিত করানো হয়”।
অন্যদিকে নিতীশ সেনগুপ্তের মতে, এর ঐতিহ্যগত নামটি হল বঙ্গাব্দ যাকে সম্রাট আকবরের সময় তারিখ-ই-ইলাহি বলা হত । বর্ষপঞ্জির এই তারিখ-ই-ইলাহি ভারশনে, প্রতিটি দিন এবং মাসের আলাদা আলাদা নাম ছিল, আর এখন যে মাসের নামগুলো দেখা যাচ্ছে তারিখ-ই-ইলাহিতে এরকম মাসের নামের বদলে অন্য মাসের নাম ছিল। আকবরের পৌত্র শাহ জাহান রবিবার দিয়ে শুরু হওয়া সাত দিনের সপ্তাহের প্রচলনের জন্য এই তারিখ-ই-ইলাহি বর্ষপঞ্জির সংস্কার করেন এবং একই সাথে কোন এক অজানা সময়ে তৎকালীন সময় প্রচলিত শকাব্দে (ভারতীয় জাতীয় বর্ষপঞ্জি) থাকা মাসের নামের সাথে মিলিয়ে তারিখ-ই-ইলাহির মাসের নামকরণ করা হয়। আজ বাংলায় যে বর্ষপঞ্জিটি ব্যবহার করা হয়, সেই বর্ষপঞ্জিটিই তার ভিত্তি স্থাপন করে।
মুঘল আমলে, ইসলামিক হিজরি বর্ষপঞ্জি অনুসারে বাঙ্গালিদের থেকে খাজনা আদায় করা হত। সেই বর্ষপঞ্জিটি ছিল একটি চান্দ্র্য বর্ষপঞ্জি, আর তাই সৌর কৃষিচক্রের সাথে সেই বর্ষপঞ্জিটির কোন সমন্বয় ছিল না কোন কোন উৎস্য অনুযায়ী, খাজনা দানের সময় যে উৎসব এর আয়োজন হত সেই রীতি মুঘল সম্রাট আকবরেরই তৈরি, আর তখন থেকেই বাংলা সালকে বঙ্গাব্দ বলা হত। আকবর তার রাজজোতিষী ফতুল্লাহ শিরাজীকে চান্দ্র্য ইসলামিক বর্ষপঞ্জি এবং সৌর হিন্দু বর্ষপঞ্জিকে সমন্বিত করে একটি বর্ষপঞ্জি তৈরি করতে বলেন। আকবরের দেয়া আজ্ঞা পালন করে ফতুল্লাহ শিরাজী যে বর্ষপঞ্জি তৈরি করে দেন তা ফশলি শান (কৃষি বর্ষপঞ্জি) নামে পরিচিত ছিল। কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে, এখান থেকেই বাংলা বর্ষপঞ্জির সূচনা হয়। শামসুজ্জামান খানের মতে, সম্ভবত মুঘল গভর্নর নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ সর্বপ্রথম পুণ্যাহ এর রীতি (খাজনা আদায় করার জন্য একটি উৎসবের দিন) চালু করেন। আর এটা করার সময়ই তিনি আকবরের বার্ষিক খাজনা আদায়ের নীতি গ্রহণ করেন।
আবার এটাও অস্পষ্ট যে বাংলা বর্ষপঞ্জি হুসেন শাহ না আকবর কর্তৃক গৃহীত হয়। বাংলা বর্ষপঞ্জির রীতি আকবরের পূর্বে হুসেন শাহ চালু করে থাকতে পারেন। নিতীশ সেনগুপ্ত বলেন, বাংলা বর্ষপঞ্জি হুসেন শাহই শুরু করুন আর আকবরই, এটা বাংলার ঐতিহ্যগত বর্ষপঞ্জির ভিত্তিতে বসন্তের ফসল সংগ্রহের পর খাজনা আদায় করার কাজ সহজ করে দিয়েছিল। কারণ ইসলামী হিজরি বর্ষপঞ্জি খাজনা আদায়ের দিন ধার্য করার ক্ষেত্রে বেশ কিছু প্রশাসনিক জটিলতার সৃষ্টি করে।
হিন্দু বা বৌদ্ধ প্রভাব
কোন কোন ঐতিহাসিক বলেন বাংলা বর্ষপঞ্জি এসেছে ৭ম শতকের হিন্দু রাজা শশাঙ্কের কাছ থেকে। আকবরের সময়ের অনেক শতক আগে নির্মিত দুটি শিব মন্দিরে বঙ্গাব্দ শব্দটির উল্লেখ পাওয়া যায়। আর এটাই নির্দেশ করে, আকবরের সময়ের আরও অনেক আগেও বাংলা বর্ষপঞ্জির অস্তিত্ব ছিল।
বৈদিক আচার অনুষ্ঠানের জন্য কোন সময়ে কি কাজ হবে এধরনের ধারণা অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বৈদিক যুগের জ্যোতিঃশাস্ত্রে পারদর্শীগণ তখন মহাকাশের বিভিন্ন জ্যোতিষ্কের চলাফেরা দেখে সময় সম্পর্কিত হিসাব নিকাশ ও এই সব আচার অনুষ্ঠানের দিন নির্ধারণ করার কাজ করতেন। জ্যোতিঃশাস্ত্র বিষয়ক পাঠ ছিল ছয়টি প্রাচীন বেদাঙ্গ বা বেদ সংক্রান্ত ছয়টি প্রাচীন বিজ্ঞানের একটি- যেগুলো হিন্দুধর্মগ্রন্থের অংশ। বৈদিক আচার অনুষ্ঠানের জন্য প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতি একটি উন্নত ও পরিশীলিত সময় নির্ণয় কৌশল এবং বর্ষপঞ্জি প্রস্তুত করে।
হিন্দু বিক্রমী বর্ষপঞ্জির নামকরণ করা হয় বিক্রমাদিত্যের নাম অনুসারে, এটা শুরু হয় খ্রিষ্টপূর্ব ৫৭ অব্দ থেকে। ভারত ও নেপালের অনেক স্থানের মত গ্রামীণ বাঙ্গালী সম্প্রদায়ে বাংলা বর্ষপঞ্জির কৃতজ্ঞতা বিক্রমাদিত্যকে দেয়া হয়। কিন্তু অন্যান্য অঞ্চলে খ্রিষ্টপূর্ব ৫৭ অব্দে সেই বর্ষপঞ্জির সূচনা হলেও বাংলা বর্ষপঞ্জি শুরু হয়েছিল ৫৯৩ খ্রিষ্টাব্দে যা নির্দেশ করে কোন একটা সময়ে বঙ্গাব্দের আদর্শ বিন্দু বা রেফারেন্স পয়েন্টকে পরিবর্তিত করা হয়েছিল।
হিন্দু পণ্ডিতগণ সূর্য, চন্দ্র এবং অন্যান্য গ্রহসমূহের ক্রমাবর্তনকে পর্যবেক্ষণ এবং হিসাব করে সময়ের হিসাব রাখার চেষ্টা করতেন। সূর্য সম্পর্কিত এই হিসাব নিকাশ সংস্কৃত ভাষার বিভিন্ন জ্যোতিঃশাস্ত্র বিষয়ক গ্রন্থে উঠে এসেছে, যেমন ৫ম শতকে আর্যভট্ট কর্তৃক রচিত আর্যভট্টীয়, ৬ষ্ঠ শতকে লটদেব কর্তৃক রচিত রোমক এবং বরাহমিহির কর্তৃক রচিত পঞ্চসিদ্ধান্তিকা, ৭ম শতকে ব্রহ্মগুপ্ত কর্তৃক রচিত খাণ্ডখাণ্ড্যক ইত্যাদি। এই গ্রন্থগুলোতে সূর্য সহ ও বিভিন্ন গ্রহ সম্পর্কে লেখা হয় এবং এদের স্থানান্তর সম্পর্কিত হিসাব-নিকাশ এবং বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হয়। অন্যান্য গ্রন্থ যেমন সূর্য সিদ্ধান্ত ৫ম থেকে ১০ শতকে রচিত হয় এবং এর অধ্যায়গুলোতে বিভিন্ন গ্রহ এবং দেব দেবী সংক্রান্ত পুরাণ দেখা যায়।
ভারতীয় রাজ্যগুলো যেমন পশ্চিমবঙ্গ্, ত্রিপুরা এবং আসামের বাঙ্গালীদের ব্যবহৃত বাংলা বর্ষপঞ্জি সূর্য সিদ্ধান্ত নামক সংস্কৃত গ্রন্থের উপর ভিত্তি করে বানানো বলে অনেকে বলে থাকেন। এখানে মাসগুলোর ঐতিহাসিক সংস্কৃত নাম রক্ষা করা হয়, সেই সাথে এর প্রথম মাসের নামও বৈশাখ। এই বর্ষপঞ্জি হিন্দু বর্ষপঞ্জি ব্যবস্থার সাথে শক্তভাবে বন্ধনে আবদ্ধ এবং বিভিন্ন বাঙ্গালী হিন্দু উৎসব এটা দেখে ঠিক করা হয়।
No comments