ভাষার অবয়ব পরিকল্পনা (Corpus Planning of Language) এবং বাংলাদেশে ভাষার অবয়ব পরিকল্পনা
ভাষা পরিকল্পনাঃ ভাষা পরিকল্পনা জ্ঞান শাখাটি ভাষাতত্ত্বের আধুনিকতম শাখা, সমাজভাষাতত্ত্বের একটি অতি আধুনিকতম জ্ঞান শাখা। সামাজিক প্রয়োজনেই ভাষা পরিকল্পনার উদ্ভব। ‘পরিকল্পনা’ শব্দের অর্থ হল চিন্তন, উদ্ভাবন, কোন কাজের সুচিন্তিত রূপরেখা। যা এলোমেলো অগোছালো তা শৃঙ্খলায় আনা; যা নেই, তা সৃষ্টি করা; বিশেষ কোনো প্রয়োজন সাধনের জন্য কোন একটি বিষয়কে মানুষের উপযোগী করে গড়ে তোলার জন্যই পরিকল্পনা শব্দটি ব্যবহার করা যায়। ভাষার ক্ষেত্রেও পরিকল্পনা শব্দটির প্রয়োগ বাস্তবতা সমর্থিত।
বর্তমান পৃথিবীতে এমন কোনো মানব সমাজ নেই, যেখানে ভাষা নেই; আবার এমন কোনো ভাষা নেই, যেখানে সমস্যা নেই। ভাষায় সমস্যা থাকলেই সেখানে পরিবর্তনের প্রশ্ন আসে, সুচিন্তিত পরিকল্পিত সমাধানের পথ খুঁজে বের করতে হয়। ভাষার সমস্যা সমাধানের সচেতন প্রয়াসকে ভাষা পরিকল্পনা বলে।
ড. মোরশেদের মতে,“ভাষা-পরিকল্পনা আসলে মানুষের ভাষিক যোগাযোগ সমস্যা সমাধানের পরিকল্পনা। ‘ভাষায় বিভিন্ন সমস্যা রয়েছে এবং এসব সমস্যা সমাধানের জন্য উত্তম-সিদ্ধান্ত গ্রহণকে ভাষা-পরিকল্পনা বলা হয়, ভাষা বলায় এবং লেখায় পরিবর্তন আনয়ন করা যায় এবং ভাষার সুবিবেচিত পরিবর্তনই ভাষা পরিকল্পনা।”
Haugen ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে পরিকল্পনার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, “কোন অসমরূপসম্পন্ন ভাষা-সম্প্রদায়ের লেখক ও বক্তার পথ নির্দেশনার জন্য আদর্শ লিখনরীতি বা লিপিরীতি, ব্যাকরণ ও অভিধান তৈরির যে সব কাজ সেগুলোকে ভাষা পরিকল্পনা বলা যায়।”
১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দে Fishman এর দেয়া সংজ্ঞা অনুসারে বলা যায়, ভাষার মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য এবং ভাষার উপাদানগুলির লক্ষ্য পূরণের জন্য কর্তৃপক্ষ কর্তৃক বিভিন্ন উপাদান ও পদ্ধতি প্রয়োগ করাই হল ভাষা পরিকল্পনা। পুরনো প্রয়োগ যেগুলি বাদ দেবার সেগুলি বাদ দেওয়া এবং গ্রহণযোগ্য উপাদান গ্রহণ করা এর অন্তর্গত।
এক কথায় ভাষা পরিকল্পনার সংজ্ঞা দেওয়া বোধহয় দুরুহ। উপোরোক্ত সংজ্ঞা ও আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, মানুষের প্রয়োজনানুযায়ী ভাষা ব্যবহার করার উদ্দেশ্যে ভাষার যে সুচিন্তিত পরিমার্জনা করা হয়, তাই হল ভাষা-পরিকল্পনা।
ভাষার অবয়ব পরিকল্পনাঃ ভাষার নিজস্ব অবয়ব আছে । ভাষাকে বিশ্লেষণ করলে তার দেহ গঠনের উপাদানসমুহের সন্ধান পাওয়া যায়। ভাষা যেহেতু স্বেচ্ছাপ্রণোদিত মস্তিস্কজাত মানবীয় যোগাযোগ মাধ্যম,সেজন্য ভাষার দেহ গঠনেও কোনো কৃত্রিমতা নাই। ভাষার দেহ গঠনের বিষয়টি লিপি আবিষ্কারের পর মানুষের নজরে এসেছে বলে প্রতীয়মান হয়।
যে সব ভাষার লিপি আবিষ্কৃত হয়েছে ও বহুলভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে, সেসব ভাষার লিপি ব্যবহারের ক্ষেত্রে কোন সীমাবদ্ধতা থাকলে তা দূর করা, বানান রীতির অসঙ্গতি থাকলে তার সমাধান করা, ব্যকরণগত সমস্যার সমাধান করা, সর্বোপরি একটি আদর্শ ভাষা রূপে গড়ে তোলার প্রক্রিয়াকে ভাষার অবয়ব বা আঙ্গিক পরিকল্পনা বলা হয়। অন্যদিকে, যেসব ভাষার লিপি আবিস্কৃত হয়নি কিন্তু সরকারি কাজে, শিক্ষাক্ষেত্রে ও যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করার জন্য, সেসব ভাষার লিপি সৃষ্টি বা নির্ধারণ করা ও সংগঠনগত অনান্য জটিলতা দূর করা অবয়ব বা আঙ্গিক পরিকল্পনার কাজ। এক কথায় ভাষা দেহের সর্বাঙ্গীন পরিনতি সাধন করাই অবয়ব পরিকল্পনার উদ্দেশ্য।
ভাষার সংগঠনকে পূনর্মূল্যায়ন ও নতুন আঙ্গিকে ভাষাকে পূনর্বিন্যাস করার ক্ষেত্রে অবয়ব পরিকল্পনার বিকল্প নাই। ভাষা সংগঠনের জটিলতা বা অসঙ্গতিকে দূর করার জন্য বানান, শব্দ ও বাক্যের অভ্যন্তরীণ পরিমার্জন, পরিবর্তন, সংযোজন, সংশোধন ইত্যাদি বিষয়কে অবয়ব পরিকল্পনা বলে।
ভাষার অবয়ব পরিকল্পনা বা কর্পাস প্ল্যানিং (CP) বলতে কোনো ভাষার বানান, পরিভাষা, উচ্চারণ প্রমিতকরণ, ব্যাকরণ-অভিধান প্রণয়ন, নতুন বর্ণের অভিযোজন ইত্যাদিকে বোঝানো হয়।
ভাষার অবয়ব পরিকল্পনা বিস্তারিত:
‘বাংলাদেশে ভাষাসমূহের অবয়ব পরিকল্পনা’ মূলত বাংলা বর্ণমালা, বানান, উচ্চারণ, পরিভাষা, অভিধান ও ব্যাকরণ নিয়ে আলোচনা স্থান পেয়েছে। প্রমিত উচ্চারণ নির্মাণ করা কিংবা কোনো ভাষার উচ্চারণকে প্রমিত করা ভাষার অবয়ব পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্তি।
বাংলাদেশে বাংলা ভাষার অবয়বগত বা উপাদানগত বিষয়, যেমন – প্রমিত বানান, উচ্চারণ, প্রতিবর্ণীকরণ, পরিভাষা ও ব্যাকরণের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে যেমন মতভেদ আছে, তেমনি আদিবাসীদের ভাষার অবয়বগত ও অবস্থানগত সমস্যাও প্রত্যক্ষযোগ্য। এগুলোর উদারনৈতিক ভাষাতাত্ত্বিক ও জাতিতাত্ত্বিক সমাধান বিনির্মাণ দেশপ্রেমের স্বার্থেই জরুরি হয়ে পড়েছে।
No comments