Header ads

ভাষা পরিকল্পনা (Language Planning), ভাষা পরিকল্পনার গুরুত্ব বা তাৎপর্য

 ভাষা পরিকল্পনা কী? ভাষা পরিকল্পনা ধারণার তাৎপর্য ব্যখ্যা করুন।

ভাষা পরিকল্পনা কী? ভাষা পরিকল্পনা ধারণার তাৎপর্য ব্যখ্যা করুন।

উত্তরঃ 
ভাষা পরিকল্পনাঃ ভাষা পরিকল্পনা জ্ঞান শাখাটি ভাষাতত্ত্বের আধুনিকতম শাখা, সমাজভাষাতত্ত্বের একটি অতি আধুনিকতম জ্ঞান শাখা। সামাজিক প্রয়োজনেই ভাষা পরিকল্পনার উদ্ভব। ‘পরিকল্পনা’ শব্দের অর্থ হল চিন্তন, উদ্ভাবন, কোন কাজের সুচিন্তিত রূপরেখা। যা এলোমেলো অগোছালো তা শৃঙ্খলায় আনা; যা নেই, তা সৃষ্টি করা; বিশেষ কোনো প্রয়োজন সাধনের জন্য কোন একটি বিষয়কে মানুষের উপযোগী করে গড়ে তোলার জন্যই  পরিকল্পনা শব্দটি ব্যবহার করা যায়। ভাষার ক্ষেত্রেও পরিকল্পনা শব্দটির প্রয়োগ বাস্তবতা সমর্থিত। 

বর্তমান পৃথিবীতে এমন কোনো মানব সমাজ নেই, যেখানে ভাষা নেই;  আবার এমন কোনো ভাষা নেই, যেখানে সমস্যা নেই। ভাষায় সমস্যা থাকলেই সেখানে পরিবর্তনের প্রশ্ন আসে, সুচিন্তিত পরিকল্পিত সমাধানের পথ খুঁজে বের করতে হয়। ভাষার সমস্যা সমাধানের সচেতন প্রয়াসকে ভাষা পরিকল্পনা বলে। 

ড. মোরশেদের মতে,ভাষা-পরিকল্পনা আসলে মানুষের ভাষিক যোগাযোগ সমস্যা সমাধানের পরিকল্পনা।ভাষায় বিভিন্ন সমস্যা রয়েছে এবং এসব সমস্যা সমাধানের জন্য উত্তম-সিদ্ধান্ত গ্রহণকে ভাষা-পরিকল্পনা বলা হয়। ভাষা বলায় এবং লেখায় পরিবর্তন আনয়ন করা যায় এবং ভাষার সুবিবেচিত পরিবর্তনই ভাষা পরিকল্পনা।

Haugen ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে পরিকল্পনার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, “কোন অসমরূপসম্পন্ন ভাষা-সম্প্রদায়ের লেখক ও বক্তার পথ নির্দেশনার জন্য আদর্শ লিখনরীতি বা লিপিরীতি, ব্যাকরণ ও অভিধান তৈরির যে সব কাজ সেগুলোকে ভাষা পরিকল্পনা বলা যায়।”

১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দে Fishman এর দেয়া সংজ্ঞা অনুসারে বলা যায়, ভাষার মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য এবং ভাষার উপাদানগুলির লক্ষ্য পূরণের জন্য কর্তৃপক্ষ কর্তৃক বিভিন্ন উপাদান ও পদ্ধতি প্রয়োগ করাই হল ভাষা পরিকল্পনা। পুরনো প্রয়োগ যেগুলি বাদ দেবার সেগুলি বাদ দেওয়া এবং গ্রহণযোগ্য উপাদান গ্রহণ করা এর অন্তর্গত। 

এক কথায় ভাষা পরিকল্পনার সংজ্ঞা দেওয়া বোধহয় দুরুহ।  উপোরোক্ত সংজ্ঞা ও আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, মানুষের প্রয়োজনানুযায়ী ভাষা ব্যবহার করার উদ্দেশ্যে ভাষার যে সুচিন্তিত পরিমার্জনা করা হয়, তাই হল ভাষা-পরিকল্পনা।  
ভাষা পরিকল্পনার ধারণা: ভাষা পরিকল্পনা ধারণাটি বিংশ শতাব্দীর অবদান হলেও, এই ধারণা-সম্পৃক্ত বিষয়কে আরো প্রাচীনকালে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে। পৃথিবীর প্রাচীনতম ভাষা পরিকল্পক পাক-ভারত উপমহাদেশের অধিবাসী ছিলেন - তিনি হলেন ব্যাকরণকার পাণিনি। খ্রিস্টপূর্ব  ৫ম শতকে তিনি সংস্কৃত ভাষায় ভাষা সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলেন। তিনি সংস্কৃত ভাষাকে সুপরিকল্পিতভাবে মান্যায়িত করে, তাকে সমস্যামুক্ত করে, সে ভাষার একটি সুস্থিত রূপ দেন। তাঁর রচিত ‘অষ্টাধ্যায়ী’ গ্রন্থ ভাষা পরিকল্পনার আদি নিদর্শন। 

‘ভাষা পরিকল্পনা’ পরিভাষাটি আধুনিক তবে বিষয়টি আরো গভীর, আরো প্রাচীন যা মানুষের আদি সত্তার সাথে মিশে আছে। প্রাক-কৃষি যুগে মানুষ খাদ্যান্বেষনের জন্য পশু শিকারের উদ্দেশ্যে তৈরি করেছে নানা প্রকার অস্ত্র। পশুর চামড়া, গাছের বাকল, লতা পাতা দিয়ে তৈরি করেছে পোশাক। একজন অন্যজনের বিপদে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে। এসব করার জন্য ভাষার প্রয়োজন। মানে মানুষ নিজের প্রয়োজনে আদিকাল থেকেই ভাষা-পরিকল্পনা করে আসছে। যখন তারা দূর-জঙ্গলে শিকারের উদ্দেশ্যে গিয়েছে তখন তাদের ধ্বনি ছিল একরকম। শিকার পাওয়ার পর তাদের ধ্বনিতে পার্থক্য ছিল। আবার তারা বিপদের সম্মুখীন হলে অন্য ধ্বনি ব্যবহার করত। এসব বিচিত্র ভাষিক বিষয়গুলো অন্যরা বুঝত মানে সেগুলো পরিকল্পিত ছিল। এভাবে অসংখ্য ভাষিক উপযোগিতার অপূর্ব শৃঙ্খলার মাধ্যমে আদিকাল থেকেই  মানুষ ভাষা-পরিকল্পনা করে আসছে। 

তবে পরিকল্পনার বিষয়টি, প্রাচীনকালে বর্তমানকালের মতো ছিল না। এর অন্যতম কারণ, তখন মানুষ ছিল সত্যিকার অর্থেই অসহায়। নানা রকম হিংস্র পশু-পাখি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে লড়াই করে তাদের চলতে হত। তারা নিজেদের রক্ষা করার জন্য নানাবিধ কৌশল আবিষ্কার করেছে। আর সে কৌশলের প্রথম ও প্রধান সার্থক আবিষ্কারের সাধ পেয়েছে মানুষ ভাষার মতো অপূর্ব যোগাযোগ মাধ্যম আবিষ্কারের ফলে। যুগের ও কালের পরিবর্তনের ধারায় মানুষ গড়ে তুলেছে নতুন সভ্যতা, নতুন সমাজ। সে সমাজের নানাবিধ প্রয়োজন সাধনের উদ্দেশ্যে ভাষায় এসেছে বৈচিত্র। 

বর্তমান সমাজ অনুযায়ী ব্যবহৃত হচ্ছে বর্তমান ভাষা। সমাজের যেমন পরিবর্তন হয়েছে; ভাষারও তেমন পরিবর্তন হয়েছে। কম্পিউটার আবিষ্কারের পূর্বে ভাষায় কম্পিউটার শব্দটি ছিল না। মাউস (Mouse) শব্দের অর্থ ইদুর; কিন্তু বর্তমান সময়ে মাউস (Mouse) বলার সাথে সাথে কেউ আর ইদুরের কথা প্রথমে ভাবেন না, বলেনও না। সেখানে বলেন, কম্পিউটারের একটি অতি প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশের নাম মাউস (Mouse)। 

সামাজিক কারণে ভাষা-পরিকল্পনা করা হয়। ‘ভাষা-পরিকল্পনা’ পরিভাষাটির ইতিহাস নাতিদীর্ঘ। Uriel Weinreich ১৯৫৭ সালে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সেমিনারের আলোচ্য বিষয়ের জন্য পরিভাষাটি সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন। ক্রমে রায় (১৯৬১), তৌলি (১৯৬৪) এবং হগেন (১৯৬৬) ভাষা-পরিকল্পনার তাত্ত্বিক ভিত্তিভূমিকে প্রশস্ততা দান করে প্রতিষ্ঠিত করেন। 
ভাষা পরিকল্পনার তাৎপর্য: বাগযন্ত্রের সাহায্যে উচ্চারিত অর্থবহ ধ্বনি বা ভাষা লোকের মুখে মুখে নানা যুগে, নানা স্থানে বিভিন্ন রকম রূপ পায়। যখন আমরা সেই ভাষার লিখিত রূপ দেই, তখন মুখের ভাষার সঙ্গে অনেক তফাত দেখা যায়। অনেক দিন ধরে চলে আসা বানান-লিপি এক সময় দেখা যায় স্থবির হয়ে পড়েছে। তখন সেই অসংগতি দূর করার দরকার হয়। দরকার হয় সমস্যাগুলির সমাধান করা। আর রক্ষণশীল স্থবির নিময়কে আধুনিক যুগের উপযোগী করে নিতে হয়। আর এক্ষেত্রে ভাষা-পরিকল্পনার গুরুত্ব অপরিসীম। 

কালের ও যুগের ধারায় ভাষা পরিবর্তিত হয়। ভাষার মধ্যে নতুন নতুন ধ্বনি ও অর্থের অস্তিত্ত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। আবার অনেক পরিচিত ধ্বনি ও অর্থ হারিয়ে যায়। এ পরিবর্তনের ধারা অব্যাহত গতিতে চলতে থাকে। পাণিনি-পূর্ববর্তীকাল থেকে শুরু করে আজ অবধি যেসব ভাষাতাত্ত্বিক ভাষাচর্চা করেছেন বা করছেন; তারা সবাই এক অর্থে ভাষা-পরিকল্পনা করেছেন বা করছেন। কারণ ভাষাকে সুশৃঙ্খল ও ব্যবহার উপযোগী  করে তোলার বিষয়টি ‘ভাষা-পরিকল্পনা’ নামক জ্ঞান শাখার কাজ। আর, ভাষা সম্পর্কিত মানুষের  সব চিন্তাধারা ও বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ, ভাষা ব্যবহার উপযোগী করে গড়ে তোলার সাথে ভাষা-পরিকল্পনা সংশ্লিষ্ট। 

তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর সামাজিক, অর্থনীতিক ও রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের ফলে ‘ভাষা-পরিকল্পনা’ সংক্রান্ত্র জ্ঞান শাখাটির উপযোগিতা ব্যাপকভাবে অনুভূত হয়। এর অন্যতম কারণ, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো বহুকাল যাবৎ ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে থাকার ফলে তাদের নিজস্ব ভাষা, সমাজ ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগ অনেকাংশে ছিল অবরুদ্ধ। ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানের পর, বিশেষ করে ভাষাগত যে সমস্যা দেখা দিয়েছিল, তা সুপরিকল্পিতভাবে সমাধানের চেষ্টা হয়েছে। 

পরিকল্পনা ছাড়া কোন কিছুর স্থায়িত্ব থাকে না। সঠিক পরিকল্পনার অভাবে মারাত্মক ক্ষতি সাধিত হতে পারে। ভাষার অলংকার দিয়ে যে সংস্কৃতি গড়ে ওঠে, তার ক্ষতি হলে সে ক্ষতি জাতিকে অনেক নিচে নামিয়ে দেয়। মানুষ হয়তো প্রথমে বুঝতে পারে না, বা বোঝার চেষ্টা করে না। কিন্তু একটা সময় আসে, যখন জাতিকে হারিয়ে যাওয়া দুর্লভ সাংস্কৃতিক বিষয়ের জন্য মূল্য দিতে হয়। পরিকল্পনার অভাবে কোনো জাতির মৌলিক সংস্কৃতির কোনো অংশের মৃত্যুও ঘটতে পারে। মৃত্যুর পর সে সাংস্কৃতিক বিষয়ের  কথা বহুদিন পর, বহুকাল পর. বইয়ের পাতায় ইতিহাস হয়ে থাকতে পারে। আবার ইতিহাসের পাতা থেকে মুছেও যেতে পারে। যেমন- বাংলাদেশের নিজস্ব একটি সঙ্গীত ছিল - কবিগান। শুধুমাত্র পরিকল্পনার অভাবে কবিগান হারিয়ে গেছে। পৃথিবীর কোনো দেশ থেকে বাঙালিদের কবিগান ধার করতে হয়নি, এটা ছিল তাদের মৌলিকত্ব, তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির পরিচায়ক। কিন্তু পরিকল্পনার ব্যর্থতার কারণে বাঙালি সংস্কৃতির  অমূল্য ক্ষতি সাধিত হল। যা কেউ অনুভব করলো, কেউ বা করলো না। 

উপরোক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, ভাষা সমস্যার সমাধান, ভাষার উন্নয়ন সর্বোপরি ভাষাকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে ভাষা-পরিকল্পনার তাৎপর্য  অপরিসীম। 

No comments

Theme images by Maliketh. Powered by Blogger.