সর্বপ্রাণবাদ, মহাপ্রাণবাদ ও মানা | Animism, Animatism and Mana
সর্বপ্রাণবাদ, মহাপ্রাণবাদ ও মানা
ধর্মের উৎপত্তি, আদিরূপ বা ক্রমবিকাশ সম্পর্কে উনিশ শতকের বিবর্তনবাদী নৃবিজ্ঞানীদের প্রণীত বিভিন্ন তত্ত্ব ও ব্যাখ্যা পরবর্তীতে আর ব্যাপকভাবে অনুসৃত না হলেও তাদের ব্যবহৃত কিছু মৌলিক প্রত্যয় এখনো নৃবিজ্ঞানে চালু আছে। এরকমই দুটি প্রত্যয় হল ‘সর্বপ্রাণবাদ’ (animism) ও ‘মহাপ্রাণবাদ’ (animatism) ।
সর্বপ্রাণবাদঃ সর্বপ্রাণবাদ হল সকল ইতর প্রাণী, উদ্ভিদ, নদী, সাগর, বজ্রপাত, স্থান, পদার্থ এমনকি শব্দেরও একটি আলাদা সত্তার নির্যাস বা আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাস। ব্রিটিশ নৃবিজ্ঞানী স্যার এডওয়ার্ড বার্নেট টায়লর ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে এই মতবাদ প্রদান করেন। সর্বপ্রাণবাদ এর ইংরেজি animism শব্দটি এসেছে ল্যাটিন animus থেকে, যার অর্থ আত্মা। ই. বি. টায়লরের মতে সকল ধর্মের মূলে রয়েছে এই বিশ্বজনীন সাংস্কৃতিক প্রপঞ্চ, অর্থাৎ আত্মার ধারণায় বিশ্বাস, যাকে তিনি animism হিসাবে অভিহিত করেছেন। তাঁর মতে ধর্ম হল ‘বিভিন্ন আত্মা-রূপীয় সত্তায় বিশ্বাস’ (belief in spirit beings) ।আত্মা-রূপীয় সত্তা বলতে টায়লর আত্মা তথা বিভিন্ন অতিপ্রাকৃত, অশরীরী সত্তা যেমন ভূত-প্রেত, দেব-দেবী, ইশ্বর প্রভৃতিকে বুঝিয়েছেন। টায়লরের মতে আত্মার ধারণা ছিল আদিম মানুষদের একটি উল্লেখযোগ্য বুদ্ধিবৃত্তিক অর্জন, ধর্মের বিবর্তনের প্রথম ও প্রধান সোপান। তিনি তাঁর Primitive Culture গ্রন্থে দেখানোর চেষ্টা করেছেন যে, আত্মার ধারণার সম্প্রসারিত রূপ হিসাবেই বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় ভূত-প্রেত, দেব-দেবী প্রভৃতির ধারণা ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানের উৎপত্তি ঘটেছে।
আদিম মানুষ আত্মার ধারণা পেয়েছে ঘুম, স্বপ্ন, মৃত্যু, মুর্ছা যাওয়া ইত্যাদির মত কিছু সাধারণ ও সার্বজনীন মানবিক অভিজ্ঞতার ব্যাখ্যা খুঁজতে গিয়ে। মানুষ স্বপ্নে যেন ভিন্ন একটা জগতে বিচরণ করে। সে বহু দূরে বেড়াতে যায়, পাহাড় পর্বতে চড়ে, শিকার করে, আকাশে উড়ে বেড়ায়, এমনকি মৃত ব্যক্তিদের সাথেও সাক্ষাত হয়। কিন্তু ঘুম ভাঙার পর সে দেখে তার দেহ সেখানেই আছে। তারা মনে করত যে, মানুষ ঘুমিয়ে পড়লে আত্মা ভ্রমণে বের হয়। দেহ থেকে আত্মার সাময়িক অনুপস্থিতি হল ঘুম। আর স্থায়ী বিচ্ছেদ হল মৃত্যু। এছাড়াও মুর্ছা যাওয়া হল আত্মার সাময়িক দেহত্যাগ, মৃত্যুর বেলায় তা ঘটে চিরতরে। মৃত্যুর পর দেহ পচে যায়, নষ্ট হয়, কিন্তু আত্মা বিনষ্ট হয় না।
আত্মা আশেপাশে বসবাস করে এবং মাঝেমধ্যে জীবন্ত লোকের ওপর ভর করে তাতে তার মঙ্গল-অমঙ্গল ঘটে; একে ‘আছর’ করা বলে। এর ফলে একজন ব্যক্তি হঠাৎ ভিন্ন কারো মত আচরণ করতে থাকে, যেনবা তার মধ্যে অন্য কারো অশরীরী উপস্থিতি রয়েছে। তাই আত্মা-প্রেতাত্মাকে খুশি রাখার জন্য বা সহায়তা লাভের লক্ষ্যে আদিম মানুষ মৃত পূর্ব পুরুষদের আত্মাসমূহের পূজার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠান পালন করত। ‘পূর্বপুরুষ পূজা’র (ancestor worship) পরবর্তী পর্যায়ে এই ধারণার বিকাশ ঘটে যে, শুধু মানুষেরই আত্মা নেই, অন্যান্য প্রাণীরও আত্মা রয়েছে , এমনকি জড়বস্তুর ভেতরেও আত্মা-রূপীয় সত্তা থাকতে পারে। এ বিশ্বাসের ভিত্তিতে গড়ে ওঠে ‘প্রকৃতি পূজা’ (nature worship), এ ব্যবস্থায় চারপাশের জীবজন্তু, গাছপালা, নদী-নালা, পাহাড়-পর্বত প্রভৃতি মানুষের আরাধনার বিষয় হয়ে ওঠে। ‘প্রকৃতি পূজা’র আরো অগ্রসর ধাপে এসে মানুষে আকাশ, চন্দ্র, সূর্য, পৃথিবী, বৃষ্টি, অগ্নি প্রভুতি প্রাকৃতিক প্রপঞ্চের মধ্যে বিভিন্ন দেব-দেবীর সন্ধান পায়। এভাবেই সমাজে বহুইশ্বরবাদের অস্তিত্ব দেখা যায়। বহুইশ্বরবাদের (polytheism) পরবর্তী পর্যায়ে একেশ্বরবাদ (monotheism) এসেছে বলে টায়লর মনে করেন। একশ্বরবাদী ধর্মীয় বিশ্বাসে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী একক, অদ্বিতীয় ইশ্বরের ধারণা লক্ষ্য করা যায়। তবে একশ্বরবাদী বিশ্বাসেও আত্মার ধারণা তথা ফেরেশতার মত গৌণ অতিপ্রাকৃত সত্তার স্থান রয়েছে। সে হিসাবে ‘সর্বপ্রাণবাদ’ অতীতে ফেলে আসা কোন স্তর নয়, বরং সকল সমকালীন ধর্মেই মিশে আছে।
মহাপ্রাণবাদ ও মানা: মহাপ্রাণবাদ হল ব্যক্তিসত্তাহীন এমন একটি শক্তিতে বিশ্বাস যেটি সকল জীব ও জড় পদার্থে বিদ্যমান এবং যার উপস্থিতিতে কেউ অসাধ্য সাধন করতে সক্ষম হয়। ব্রিটিশ নৃতত্ত্ববিদ রবার্ট ম্যারেট ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে এ মতবাদ প্রদান করেন। ‘মানা’ বলতে এমন একটা বিশেষ শক্তি বা গুনকে বোঝায় যা বিভিন্ন বস্তু বা ব্যক্তির মধ্যে বিভিন্ন মাত্রায় রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। যেমন, কোন ব্যক্তির হয়ত মাছ ধরার কাজে সবসময় বা প্রায়ই বিশেষ সাফল্য অর্জন করে। সেক্ষেত্রে বলা হয় যে, সে অন্যদের চেয়ে বেশি ‘মানা’র অধিকারী। অথবা কোন জমিতে খুব ভালো ফসল হওয়ার কারণ হিসাবে হয়ত ‘মানা’- গুণ সম্পন্ন বিশেষ কোন বস্তু, যেমন অসাধারণ আকৃতির কোন পাথরের উপস্থিতি বিবেচনা করা হয়।
ম্যারেট মেলিনেশীয় ধর্মতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করতে করতে লক্ষ করলেন যে, আদিম মানুষ আত্মা বা anima-র ধারণা লাভের আগে একটি অতি প্রাকৃতিক নৈর্ব্যক্তিক শক্তিতে বিশ্বাস স্থাপন করেছিল। এটি ভূত-প্রেত, আত্মা-প্রেতাত্মার ঊর্ধ্বে এমন একটি শক্তি যেটিকে অব্যক্তিক বলে চিহ্নিত করেছিল সে যুগের মানুষ। এ শক্তির নাম দিয়েছিল তারা ‘mana' বা ‘মানা'। তারা বিশ্বাস করত এটি উদ্ভিদ-প্রাণী সবকিছুর ঊর্ধ্বে এমন একটি শক্তি যাকে ধারণ করতে হয়। যাকে ধারণ করলে অসাধ্য সাধন করা যায়। নারী-পুরুষ যে কেউ সেই অবিনশ্বর শক্তিকে তুষ্ট করে তাকে ধারণ করতে পারত এবং অন্যের মাঝে সেটি সঞ্চারিতও করা সম্ভব ছিল।
‘মানা’র পেছনে কোন দৈবসত্তা বা ইশ্বররূপী কারো হাত রয়েছে, এমনটা মনে করা হয় না। বিশেষ বিশেষ উপায়ে, নির্দিষ্ট কিছু জাদুধর্মী আচার-পদ্ধতি অনুসরণের মাধ্যমে, ‘মানা’ অর্জন করা সম্ভব বলে মনে করা হয়।
‘মানা’ বলতে কোনাে ভূত, প্রেত, আত্মা, প্রেতাত্মাকে বােঝায় না, এটা একটি নৈর্ব্যক্তিক অতিপ্রাকৃতিক শক্তি যা কোনাে ব্যক্তি বা বস্তুতে অস্বাভাবিক গুণ বােঝাতে ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ ‘মানা’ শক্তি যার মধ্যে বিরাজ করে সে অসাধারণ ও অসত্বকে সত্ব করে তােলে। আদিম মানুষ এই মানা-শক্তির উপস্থিতি অনুধাবন করে এবং সেগুলােকে ভয়, ভক্তি ও শ্রদ্ধা করতে থাকে। আর এভাবেই আদিম সমাজে ধর্মের উৎপত্তি লাভ করে।
‘মানা’র মত ধারণা আমাদের কাছেও একবারে অপরিচিত নয়। যেমন, বিশেষ কোন ব্যাট হাতে বা বিশেষ কোন জার্সি গায়ে খেললে ভাল রান তোলা বা বেশি উইকেট পাওয়া সম্ভব, এ কথা যদি কোন ক্রিকেটার বিশ্বাস করেন- বাস্তবে যে ধরনের অনেক উদাহরণ আমরা দেখি - তা হবে অনেকটা ‘মানা’ সম্পর্কে মেলানেশীয় বিশ্বাসের অনুরূপ।
দৃষ্টি আকর্ষণঃ
আমাদের ওয়েবসাইটে (Heart Academy) বিভিন্ন চাকরির বিজ্ঞপ্তিসহ চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য বিভিন্ন বিষয় নিয়ে নিয়মিতভাবে লেখা প্রকাশিত হয়ে থাকে। আমরা সাধারণ শিক্ষাসহ বিভিন্ন শিক্ষামূলক নিবন্ধ প্রকাশ করে থাকি। তাই নিয়মিতভাবে আমাদের ওয়েবসাইটটি ভিজিট করার জন্য অনুরোধ রইল। ওয়েব এড্রেস: www.heartacademy.xyz । নিয়মিত আপডেপ পেতে উপরের ডান কর্ণার থেকে ওয়েবসাইটটি Follow করে রাখেতে পারেন। মনে রাখার জন্য নিচের সোস্যাল মিডিয়া আইকনে ক্লিক করে লেখাটি আপনার টাইম লাইনে সেইভ রাখতে পারেন অথবা আপনার নিকটজনের কাছে শেয়ার করতে পারেন।
......... ধন্যবাদ।
Heart Academy
No comments