রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পে নারী চেতনার ক্রমবিকাশ
রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পে নারী চেতনার ক্রমবিকাশ
উনিশ শতকে নারীর অধিকার যখন প্রায় অকল্পনীয়, তখন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১ - ১৯৪১) নারীকে তুলে এনেছেন তার লেখনীর কেন্দ্রীয় চরিত্রে। মানুষের জয়গান গাওয়া এই সাহিত্যিকের অন্যতম কাজের জায়গা ছিল নারী জাগরণ। নারীকে তিনি উপস্থাপন করেছেন স্বাধীনচেতা, সিদ্ধান্ত দেয়ার ক্ষমতাসম্পন্ন ও সাহসী হিসেবে। শাস্ত্রে মেয়েদের বলা হয় ‘পূজার্হা গৃহদীপ্তয়’। রবীন্দ্রচেতনায় নারীকে গৃহলক্ষ্মীর সম্মানে অধিষ্ঠিত দেখার চেয়ে পুরুষের হৃদয়েশ্বরীরূপে দেখার প্রবণতা বেশি। ভারতবর্ষে যখন সংস্কার কিংবা প্রথার বাইরে যাওয়ার চিন্তা অবান্তর ছিল, তখনই নোবেলজয়ী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অবলা নারীর সবলা চরিত্র এঁকেছেন তার গল্প, কবিতা এবং উপন্যাসে।
রবীন্দ্রনাথের গল্প নারী মুক্তির দরজা খুলেছে। তার লেখায় অন্যায়ের বিরুদ্ধে নারীর প্রতিবাদী রূপ তুলে এনেছেন। রবীন্দ্র সাহিত্যে আমরা বেশ ক’জন নারীকে পাই যারা কুসংস্কারাচ্চন্ন সমাজে আধুনিকতার আলো জ্বালিয়েছেন। ‘স্ত্রীর পত্র’র মৃণাল চরিত্রে এঁকেছেন নারীর সামাজিক স্বাধীনতার কথা। যেমনটা এনেছেন, ছোটগল্প ‘সমাপ্তি’র মৃন্ময়ী, ‘ল্যাবরেটরী’র সোহানী, ‘দেনাপাওনা’র নিরুপমা, ‘হৈমন্তী’র হৈমন্তী, ‘রাসমণির ছেলে’র রাসমণি, ‘মণিহারা’র মণি, ‘পোস্টমাস্টারে’র রতন, ‘ঘাটের কথা’র কুসুম, ‘সুভা’র সুভাষিণী, ‘খাতা’র ঊমা, ‘অপরিচিতা’র কল্যাণী, ‘প্রগতিসংহারে’র সুরীতি, ‘পয়লা নম্বর’র অনিলা ও ‘শাস্তি’র চন্দরা চরিত্রের মাধ্যমে। এই চরিত্রগুলো তাদের চরিত্রের দৃঢ়তায় বাংলা সাহিত্যের পাঠকের স্মৃতিতে নিজস্ব জ্যোতিতে ভাস্বর।
রবীন্দ্রমানসে নারী শুধু কোমলতা, স্নেহ বা প্রেমের প্রতিভু নয় বরং অনেক সময়ই নারী নীতির প্রশ্নে আপোষহীন, সভ্যতার সংকটে বিবেক এবং সমাজ কাঠামোর ভিত্তি হিসেবে চিত্রিত। যুগের তুলনায় আশ্চার্যরকম অগ্রসর তার নারী চরিত্ররা। হয়তো ঠাকুরবাড়ির নারীদের মধ্যে এমন অনেকের দেখা রবীন্দ্রনাথ পেয়েছিলেন বলেই সাহিত্যে এমন নারী চরিত্র সৃষ্টি তার পক্ষে সম্ভব হয়েছিল। ব্যক্তি জীবনে রবীন্দ্রনাথ দেখেছিলেন কাদম্বরী, জ্ঞানদানন্দিনী, স্বর্ণকুমারী, সরলা ঘোষাল, ইন্দিরা দেবীর মতো বিশিষ্ট প্রতিভার অধিকারী নারীদের। সেইসঙ্গে নিজের স্ত্রী মৃণালিনী, কন্যা মাধুরীলতা, রেণুকা, মীরদেবীর মতো নারীর ছায়াও প্রতিফলিত হয়েছে তার সৃষ্ট চরিত্রে।
রবীন্দ্র গল্পগুলোতে নারী চরিত্রগুলোর বিকাশ ব্যাপকভাবে লক্ষ্যনীয়। তার প্রথম পর্যায়ের রচনাগুলোর নারী চরিত্রের ভূমিকা ও মাঝ-শেষ পর্যায়ের রচিত নারী চরিত্রগুলোর মাঝে বিশদ পার্থক্য লক্ষনীয়। প্রথম পর্যায়ের অপেক্ষা মাঝ ও শেষ পর্যাযের নারী চরিত্রগুলো বেশ বিকশিত ও আত্মমর্যাদাশীল। ছোটগল্প রচনার প্রাথমিক পর্যায়ে রবীন্দনাথ যে নারী চরিত্রগুলো আমাদের সামনে তুলে ধরেছিলেন, তারা ছিলেন বেশ সংবেদনশীল। এ পর্যায়ের রচনাগুলোতে নারীর অসহায়ত্ব, তাদের বিপন্নতা, শোচনীয় অবস্থা প্রকাশ পেয়েছে।
রবীন্দ্রণাথের জমিদারী জীবন তার সাহিত্য রচনায় বেশ প্রভাব ফেলে। জমিদারীর কাজে তাকে পল্লী বাংলার আঁনাচে কাঁনাচে ঘুরে বেড়াতে হয়। ফলে গ্রাম বাংলার সাধারণ মানুষ ও তাদের জীবনাচরণ কবির মনে আঁচড় কাটতে সক্ষম হয়। বিশেষকরে এ অঞ্চলের অবহেলিত নারী সমাজ তার আকর্ষনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়ায়। এই হত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দুঃসহ জীবনের মর্মকথা গল্পের উপজীব্য করতে গিয়ে নারী চরিত্রগুলোই হয়ে ওঠে মূল। নারী চরিত্রগুলোর মধ্যে স্পষ্ট হয়ে ওঠে তৎকালীন সমাজের নির্মম বাস্তবতা।
রবীন্দ্রনাথের প্রথম সার্থক ছোটগল্প ‘দেনাপাওনা’য় পণপ্রথার আবর্তে বলি হওয়া নিরুপমপার বিবাহিত জীবনের যে দুঃসহ অভিজ্ঞতা তা বর্ণনাতীত। সমাজে নারীর অসহায়ত্ব ও তার বোবা আর্তনাদ এখানে সুস্পষ্ট। শ্বশুর বাড়ির দুঃসহ যন্ত্রণা সহ্য করেও নিস্তব্ধতা অবলম্বন ও নীরবে সব সয়ে যাওয়ায় ছিল নারী মূর্তীর প্রতিচ্ছবি।
‘পোস্টমাস্টার’ গল্পের রতন সেই মূর্তীর আরেক রূপ। রতনের বিপন্ন সামাজিক অবস্থা তার স্বপ্ন ও আশা আকাঙ্খার প্রতিকুল ছিল। রতনের কোমল হৃদয়ে জাগ্রত প্রেম মুখ পর্যন্ত এসে পৌছায়নি। পুরুষত্বের স্বেচ্ছাচারিতা মেনে নিতে হয়েছে অকপটে। ফলে রতনের জীবনের পরিনতি হয় দুঃসহ জীবনের ঘানি টানা।
‘কঙ্কাল’ গল্পটি নারী নিগ্রহের অতি সাধারণ ঘটনা। তৎকালীন সমাজের অন্যতম বৃহৎ দুটি সমস্যা বাল্য বিবাহ আর অকাল বৈধব্য এ গল্পের উপজীব্য। যা কোন নারীকে স্বাভাবিক স্বপ্ন দেখতে বিরত রাখে।
‘জীবিত ও মৃত’ গল্পটি নারীর অসহায়ত্ব ও নারী নির্যাতনের ভিন্ন মাত্রার রূপ কল্পনা। বিধবা ও নিঃসন্তান নারীর অসহায়ভাবে বেঁচে থাকা ও জীবন চক্রের নির্মম পরিনতি স্বীকার করে মরণকে বরণ করা।
‘একরাত্রি’ গল্পের সুরবালা সমাজ বাস্তবতা ও পুরুষতন্ত্রের কাছে পরাজিত এক নারী। পুরো গল্পে তার অসহায়ত্ব ও তার কোমল হৃদয়ে উৎথিত প্রেমের বলি চড়তে দেখা যায়। পুরুষের ইচ্ছা আকাঙ্খার কাছে নারীর ইচ্ছা কতটা ভিত্তিহীন মূলহীন তা এ গল্পে স্পষ্ট হয়েছে।
তবে নারী চিরকাল এ অসহায়ত্ব, শোচনীয়তা বরণ করে নেয়নি। আত্মঅধিকার ও মর্যাদার সন্ধান তারাও করেছে। নারীর জাগরণ ও নারীত্বের বিকাশ কবির চোখ এড়ায়নি। কবি তার রচনায় ক্রমে ক্রমে এ বিকাশ তুলে ধরেছেন। তার রচিত বিখ্যাত কয়েকটি নারী চরিত্র সে সাক্ষ্য অকপটে বহন করে। এ কথা ধারণা করা যায় রবীন্দ্রনাথ নিজেই তার কয়েকটি বিখ্যাত নারী চরিত্রের মধ্য দিয়ে নারীর মুক্তির পথ অন্বেষণ করেছেন।
‘শাস্তি’ গল্পের মূল নারী চরিত্র চন্দরা। দাম্পত্য জীবনে চন্দরা বরাবরই ব্যতিক্রমী, ব্যক্তিত্বময়ী স্ত্রী রূপে নিজেকে প্রকাশ করেছে। সে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি-প্রিয়, সাহসিক ও কখনো কখনো বেপরোয়া। চন্দরার পূর্বে রবীন্দ্রনাথের গল্পে এমন চরিত্রের দেখা মিলেনি। সংসার জীবনে অভাব, দারিদ্রতার মতো প্রতিকূল পরিস্থিতি তাকে অনেক বাস্তববোধসম্পন্ন ও জীবনমূখী এক নারী করে তুলেছিল। স্বামীর প্রতি তার প্রেম গভীর ছিল বলেই তার নারীত্বের অভিমান অত্যন্ত প্রবল ছিল। তার সাবমী যখন বিশ্বাসঘাতকের মত অন্যায়ভাবে তাকে খুনের আসামী বানিয়ে দিল তখন চন্দরার কাছে এক মুহূর্তে ছিদাম স্বামীর পদ থেকে স্বামী রাক্ষসে পরিনত হল। পরবর্তীতে ছিদাম যখন চন্দরাকে বাঁচাতে চেষ্টা করে তখন চন্দরা আত্মসম্মান ও আত্মমহিমার এক অনন্য নজির সৃষ্টি করে। সে ফাঁসিরকাষ্ঠকে বরণ করে নিল অনায়াসে। ছিদাম শেষ দেখা করতে চাইলে তার বলা ‘আহ মরণ’ সংলাপটি আজও বিখ্যাত ও নারীর অভিমান প্রকাশের মূর্তী হয়ে আছে।
‘স্ত্রীর পত্র’র মৃণাল বাংলা সাহিত্যের অনন্য সম্পদ। মৃণাল সহজ স্বাভাবিক বুদ্ধির অধিকারিনী ছিলেন। অন্যায়ের প্রতিবাদ করা তার সহজাত অভ্যাস। এ প্রতিবাদী হওয়ায় তাকে অনন্যতা দাস করেছে। তার এই প্রতিবাদী স্বাভাব ও নানান চুচ্ছ বিষয়ে শ্বশুরবাড়িতে তাকে প্রতি পদে হেয় করার চেষ্টা চলেছে। তবে মৃণাল সেসব তুচ্ছ করে তার প্রতিবাদী স্বভাব অটুট রেখে দৃঢ় ব্যক্তিত্বের পুরচয় দিয়েছে। নিরাশ্রিতা বিন্দুর জন্য তার প্রতিবাদ বাংলা সাহিত্যে অবিস্মরণীয় ঘটনা। অসহায় মেয়ে বিন্দুকে সে আশ্রয় দেয় যা তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন মেনে নিতে পারেনি। তারা বিন্দুকে এক পাগলের সাথে বিয়ে দিয়ে বাড়ি থেকে তাড়ায়। শ্বশুরবাড়ির নিদারুণ যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে বিন্দু পালিয়ে আসে মৃণালের কাছে। এবার এখানে লাঞ্চনা ও অপমানের মাত্রা বেড়ে গেলে বিন্দু আত্মহত্যা করে। সংসারে নারীর অবস্থান যে কত দুঃসহ তা নতুনভাবে উপলব্ধি করে মৃণাল। সে এ অবস্থা থেকে মুক্তি পথ সন্ধান করে ও পুরীর তীর্থে চলে যায়। বাঙালি ঘরের একজন কুলবধুর এই সাহসী ভূমিকা ছিল চমকপ্রদ। নারী সত্তার এমন বিকাশ চমকে দিয়েছিল বাংলা সাহিত্যকেও। আর এ জন্যই মৃণাল বাংলা সাহিত্যে অমর হয়ে আছে।
মৃণালের মতো মুক্তির পথ সন্ধ্যানী ছিল ‘অপরিচিতা’র কল্যাণী। কল্যাণী সুন্দরী ও শিক্ষিতা। বাবার অপমান হেতু তার বিয়ে ভেঙে যায়। তার বাবা নিজেই বিয়ে ভেঙ্গে দিয়ে পাত্রপক্ষকে বিদায় করে দেয়। এখানেও আমরা সমসাময়িক মানসিকতার পরিবর্তন দেখতে পাই। নারীর অবস্থার উন্নতি ব্যাপকভাবে লক্ষণীয়। কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার অমন সাহসী আচরণ কল্যাণীর মত হাজারো নারীর মুক্তির পথ প্রদর্শক। এরপর যখন কল্যাণী সমাজসেবিকা হয়ে অনুপমের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয় তখন নারী সত্তার পূর্ণ বিকাশ কল্যাণী প্রকাশ করতে সক্ষম হয়।
‘পয়লা নম্বর’ গল্পের অনিলা নারী সত্তার প্রকাশকারী বাংলা সাহিত্যের আরেক চমকপ্রদ চরিত্র। রূপবতী ও গুণবতী অনিলা তার স্বামী অদ্বৈত চরণ-এর উদাসীনতার শিকার। সে অনিলার প্রতি এতটাই উদাসীন যে অনিলার একমাত্র ভাইয়ের আত্মহত্যার খবরটুকুও সে রাখেনি। অনিলার শারীরিক ও মানসিক অবস্থার খোঁজ সে কোনদিন নেয়নি। অপরদিকে পয়লা নম্বরের বাসিন্দা সিতাংশুমৌলী সেও অনিলার প্রেমে পড়ে যায়। তবে অনিলা পুরুষত্বের বেড়াজাল থেকে মুক্ত হতে চেয়েছে। তাই সে উভয় পুরুষকে ত্যাগ করে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। এর মাধ্যমে অনিলা সমসাময়িক নারীদের চেয়ে বিকশিত সত্তার পরিচয় দিতে সক্ষম হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথ তার চিন্তা-ধারায় ধীরে ধীরে নারীকে বিকশিত করে একটি পূর্ণমূর্তী দানে সক্ষম হয়েছেন। উচ্চশিক্ষিত ও আধুনিক নায়িকাকে তার শেষ গল্পের নায়িকা করে সেই কাজটি পূর্ণ করেছেন। তার শেষ ছোটগল্প ‘প্রগতিসংহার’ এর নায়িকা সুরীতি কলকাতা কলেজে পাঠরতা ধনীঘরের কন্যা। কলেজ জীবনেই সে নারী স্বতন্ত্রতা ও বিশিষ্পতা বিশষে সচেতন হয়ে ওঠে। তার নেতৃত্বেই প্রতিষ্ঠিত হয় ‘নারী প্রগতি সংঘ’। তারা নিজেদেরকে পুরুষের চেয়ে উত্তম দাবী করে ও প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে। যদিও শেষ পর্যন্ত জীবন বাস্তবতার কাছে সুরীতি নত স্বীকার করতে বাধ্য হয় তবুও রবীন্দ্রনাথ তাকে নারী সত্তার পূর্ণমূর্তী রূপে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছেন। এভাবেই রবীন্দ্রনাথ তার নিপুন হাতে ধীরে ধীরে নারীকে বিকশিত করতে সক্ষম হয়েছেন।
পরিশেষে বলা যায়, ‘দেনাপাওনা’ এর নিরুপমা হতে ‘প্রগতিসংহার’ এর সুরীতি পর্যন্ত নারীর যে বিকাশ রবীন্দ্রনাথ ঘটিয়েছেন তা যেন জীবন বাস্তবতার পূর্ণাঙ্গ চিত্রটিই বহন করে। সমাজে যেমন সময় গড়ানোর সাথে সাথে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ হতে নারী তার মুক্তির পথ সন্ধান করেছে, তেমনি রবীন্দ্রনাথের নারী চরিত্রগুলোও ক্রমে ক্রমে সেই বিকশিত সত্তার পরিচয় দিতে সক্ষম হয়েছে।
No comments