শামসুর রাহমানের ‘বন্দী শিবির থেকে’ কাব্যগ্রন্থ মধ্যবিত্ত শ্রেণির বেদনার্ত সত্তার প্রকাশ- আলোচনা করো।
‘বন্দী শিবির থেকে’ কাব্যগ্রন্থের মধ্যবিত্ত শ্রেণির বেদনার্ত সত্তার প্রকাশ:
শামসুর রাহমান (১৯২৯ - ২০০৬) বাংলাদেশ ও আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি। জীবদ্দশাতেই তিনি বাংলাদেশের প্রধান কবি হিসেবে মর্যাদালাভ করেছিলেন।
একটা ভাষার ও জাতির বড় কবির যে বৈশিষ্ট্য, তার অধিকাংশই শামসুর রাহমানের ছিল। সবচেয়ে বড় যে বৈশিষ্ট্যটি খালি চোখেই ধরা পড়ে তা হচ্ছে, তাঁর কবিতার একটা বড় অংশের রূপ-রূপান্তরের ইতিহাস বাংলাদেশ রাষ্ট্রের রূপ-রূপান্তরের ইতিহাসের সঙ্গে হাত ধরাধরি করে চলেছে। তাঁর কবিতা অধিকাংশ সময় পূর্ব বাংলার বাঙালি জনগোষ্ঠীর চেতনার মর্মশাঁসকে ধারণ করে শিল্পিত হয়েছে। ‘বন্দী শিবির থেকে’ কাব্যগ্রন্থের ক্ষেত্রে এ কথা একেবারে চোখ বুজে বলা যায়।
বন্দী শিবির থেকে (১৯৭২): এ কাব্যগ্রন্থে স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন আবেগ ও প্রত্যাশা প্রাধান্য পেয়েছে। এ কাব্যের মাধ্যমে তিনি কবি খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি ‘মজলুম আদিব’ ছদ্মনামে কাব্যগ্রন্থটি রচনা করেন। এ কাব্যের অধিকাংশ কবিতা মুক্তিযুদ্ধকালে অবরুদ্ধ সময়ে রচিত। এ কাব্যটি ১৯৭১ সালের শহিদদের প্রতি উৎসর্গ করা হয়। এ গ্রন্থে ৩৮ টি কবিতার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো: ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’, ’স্বাধীনতা তুমি’, ‘বন্দি শিবির থেকে’,
‘প্রবেশাধিকার নেই’, ‘পথের কুকুর’, ‘উদ্ধার’, ‘দখলি স্বত্ব’, ‘না, আমি যাব না’, আমারও
সৈনিক ছিল’, ‘মধুস্মৃতি’, ‘রক্তাক্ত প্রান্তরে’, ‘গেরিলা’, ‘ধ্বস্ত দ্বারকায়’ প্রভৃতি।
পূর্ব বাংলার মানুষ ১৯৭১ সালে জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বেল হয়ে একত্র হয়েছিল, আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে আত্মত্যাগের জন্য যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। কবি যে মুহূর্তে বলেন,
‘তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা,
সকিনা বিবির কপাল ভাঙলো,
সিঁথির সিঁদুর মুছে গেল হরিদাসীর’,
তখন আর বুঝতে বাকি থাকে না যে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি ছিল অসাম্প্রদায়িক চেতনা। এ কারণে কবি ‘সকিনা বিবি’ আর ‘হরিদাসীর’ আত্মত্যাগের বয়ানকে পাশাপাশি রেখেছেন, সমান মর্যাদা দিয়েছেন।
শুধু অসাম্প্রদায়িক চেতনা নয়, শুধু হিন্দু-মুসলিম নয়, সব ধর্ম, পেশা ও শ্রেণির মানুষ একত্রিত হয়েছিল আত্মমর্যাদা রক্ষার সংগ্রামে। কবি নিজে ছিলেন মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রতিনিধি, তাই স্বভাবতই অন্য সব কিছুর পাশাপাশি ‘বন্দী শিবির থেকে’ কাব্যগ্রন্থে মধ্যবিত্ত শ্রেণির বেদনার্ত সত্তার প্রকাশ ঘটেছে। তার প্রকাশ দেখি কবি যখন বলেন,
অথচ এ দেশে আমি আজ দমবন্ধ
এ বন্দি শিবিরে,
মাথা খুঁড়ে মরলেও পারি না করতে উচ্চারণ
মনের মতো শব্দ কোনো।
মনের মতন সব কবিতা লেখার
অধিকার ওরা
করেছে হরণ।
ত্রিশ লাখ মানুষ মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যার শিকার হয়েছিল। কিন্তু বাকিরাও কি মর্মে-হত্যার শিকার হয়নি? এই মর্মে-হত্যাও তো গণহত্যার আওতাভুক্ত। মুক্তিযুদ্ধের কাব্য-কবিতা সাধারণত এই হত্যা সম্পর্কে নিশ্চুপ থাকে। বন্দী শিবির থেকে অকথিত, অনুল্লেখিত এসব হত্যার এক অসাধারণ দলিল হয়ে উঠেছে। প্রায় প্রতিটি কবিতার পরতে পরতে আছে এসব হত্যার শ্বাসরোধী বর্ণনা। চেখে দেখা যাক কয়েকটি লাইন……….
‘আমিও নিজেকে ভালোবাসি
আর দশজনের মতন। ঘাতকের
অস্ত্রের আঘাত
এড়িয়ে থাকতে চাই আমিও সর্বদা।
অথচ এখানে রাস্তাঘাটে
সবাইকে মনে হয় প্রচ্ছন্ন ঘাতক।
মনে হয়, যে কোনো নিশ্চুপ পথচারী
জামার তলায়
লুকিয়ে রেখেছে ছোরা, অথবা রিভলবার, যেন
চোরাগোপ্তা খুনে
পাকিয়েছে হাত সকলেই।’ (‘না, আমি যাবো না’)
ভালোবাসা থমকে গিয়েছিল প্রতিমুহূর্তে মৃত্যু আর শত বেদনার বার্তায়। ‘প্রতিশ্রুতি’ কবিতায়…..
আমাদের বুকে জ্বলে টকটকে ক্ষত,
অনেকে নিহত আর বিষম আহত
অনেকেই । প্রেমালাপ সাজে না বাগানে
বর্তমানে আমাদের। ভ্রমরের গানে
কান পেতে থাকাও ভীষণ বেমানান
আজকাল । সৈন্যদল অদূরেই দাগছে কামান।
কিংবা ‘তুমি বলেছিলে’ কবিতায় শুধু তাকিয়ে দেখা ছাড়া কিছু করতে না পারার বোবাকান্নার আওয়াজ ……….
নবজাতককে
বুকে নিয়ে উদ্ভ্রান্ত জননী
বনপোড়া হরিণীর মত যাচ্ছে ছুটে।
অদূরে গুলির শব্দ, রাস্তা চষে জঙ্গী জীপ। আর্ত
শব্দ সবখানে। আমাদের দু'জনের
মুখে খরতাপ। আলিঙ্গনে থরো থরো
তুমি বলেছিলে,
'আমাকে বাঁচাও এই বর্বর আগুন থেকে, আমাকে বাঁচাও,
…………………………..
দাউ দাউ পুড়ে যাচ্ছে ঐ নয়াবাজার,
আমাদের চৌদিকে আগুন,
গুলির ইস্পাতী শিলাবৃষ্টি অবিরাম।
তুমি বলেছিলে
আমাকে বাঁচাও।
অসহায় আমি তাও বলতে পারিনি।
মধ্যবিত্তের অপারগতার করুণচিত্র আমরা দেখতে পাই ‘শমীবৃক্ষ’ কবিতায়…….
হঠাৎ কপাটে
বুটের বেদম লাথি, হাঁক-ডাঁক । তুই-তোকারির
ডাকে বান, নিমিষে উঠানে
খাকি উর্দি কতিপয়; মরণলোলুপ কারবাইন
গচ্ছিত সবার কাঁধে, কারোবা বাহুতে
চওড়া সবুজ ব্যাজ। ভয় পাওয়া জননী তাকান
তরুণ পুত্রের দিকে, লাফাচ্ছে বাঁ চোখ
ঘন ঘন; বিমূঢ় জনক প্রস্তরিত
তরুণী কন্যার হাত ধরে ত্রস্ত খুব,
ঘরের চেয়েও বেশি নিরাপদ আশ্রয় খোঁজেন
দিগ্বিদিক। যদি পারতেন
আত্মজ ও আত্মজাকে
রাখতেন লুকিযে পাতালে
নক্ষত্রবিথীর অন্তরালে কিংবা রক্তকনিকায়,
হৃদয়ের গহন স্পন্দনে।
হারানেো স্বজনদের সৎকারও করতে হয়েছে অতি সংগোপনে। অনেকের কপালে সৎকারও জোটেনি। এমনি চিত্র ফুটে ওঠেছে ‘আন্তিগোনে’ কবিতায়….
সহোদরের ছিন্ন শরীর
করলে আড়াল সংগোপনে।
সৎকার সে তো উপলক্ষ,
অন্য কিছু ছিল মনে।
আন্তিগোনে দ্যাখো চেয়ে-
একটি দুটি নয়কো মোটে
হাজার হাজার মৃতদেহ
পথের ধুলায় ভীষণ লোটে।
প্রতিমুহূর্তের এই মর্মান্তিক গণহত্যার ভাষ্য রাহমানের মুক্তিযুদ্ধের কবিতাগুলোতে একটা আলাদা মাত্রা যোগ করেছে। ‘দখলি স্বত্ব’ কবিতার বোধ আরও গভীর ও ভয়াবহ। যুদ্ধের কারণে ফেলে আসা বাড়িতে আবার ফেরার কথা মনে উঠতেই কবির মনে হয়েছে,
‘অথচ আমার
বাড়ির দখলি স্বত্ব হারিয়ে ফেলেছি।
সব কটি ঘর জুড়ে বসে আছে দেখি
বিষম অচেনা এক লোক-
পরনে পোশাক খাকি, হাতে কারবাইন।’
কী ঠান্ডা অথচ ভয়ংকর বোধ!
‘পথের কুকুর’ কবিতায় মুক্তিযুদ্ধের সময়কার অবরুদ্ধ মানুষের বোধ শিল্পিত হয়েছে এভাবে,
‘সমস্ত শহরে
সৈন্যরা টহল দিচ্ছে, যথেচ্ছ করছে গুলি, দাগছে কামান
এবং চালাচ্ছে ট্যাঙ্ক যত্রতত্র। মরছে মানুষ
পথে ঘাটে ঘরে, যেন প্লেগবিদ্ধ রক্তাক্ত ইঁদুর।
আমরা ক’জন শ্বাসজীবী—
ঠায় বসে আছি
সেই কবে থেকে। অকস্মাৎ কুকুরের
শাণিত চিৎকার
কানে আসে, যাই জানালার কাছে, ছায়াপ্রায়। সেই
পথের কুকুর দেখি বারংবার তেড়ে যাচ্ছে জলপাইরঙ
একটি জিপের দিকে, জিপে
সশস্ত্র সৈনিক কতিপয়। ভাবি, যদি
অন্তত হতাম আমি পথের কুকুর।
অবরুদ্ধতা, ক্ষোভ আর মর্মে-হত্যার এমন নিচু স্বরের অথচ গগনবিদারী শিল্পীত রূপায়ণ কথাসাহিত্য আর কাব্যসাহিত্য উভয় শাখাতেই বিরল। বন্দী শিবির থেকেতে কবি মুক্তিযুদ্ধের সময়কার ধ্বংস, দ্রোহ, অসহায়তা, আত্মপ্রত্যয়, বিশ্বাসঘাতকতা, উদ্বাস্তুতা, অন্তর্ঘাত, স্বপ্ন, সার্থকতা, নিঃস্বতার এমন নিবিড় সূক্ষ্ম আর বিস্তৃত বর্ণনা হাজির করেছেন যে অনেক সময় মনে হয় এটি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক কবিতার ঘাটতি পূরণ করে উপন্যাসের দৈন্য ঘোচানোর দিকে পা বাড়িয়েছে। কারণ বাস্তবের বিস্তৃত, খুঁটিনাটি বর্ণনাই তো উপন্যাস।
No comments