সমালোচনাসহ প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের বর্ণনা দাও।
প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্র:
প্লেটো ছিলেন একজন বিখ্যাত গ্রিক
দার্শনিক, যিনি তার "দি
রিপাবলিক" বইতে আদর্শ রাষ্ট্রের
ধারণা তুলে ধরেছিলেন। এই
রাষ্ট্র ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য ছিল
ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা, যেখানে প্রত্যেক
ব্যক্তি তাদের যোগ্যতা অনুসারে কাজ করবে এবং
সমাজের সামগ্রিক উন্নতিতে অবদান রাখবে। প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্র ছিল কাল্পনিক। বাস্তবে
রাষ্ট্র ‘কেমন হয়’ তা
না ভেবে তার ভাবনা
ও কল্পনায় ছিল সংকট মুক্তি
ও শান্তির জন্য রাষ্ট্র ‘কেমন
হওয়া উচিত’। প্লেটোর
রাষ্ট্র চিন্তা সম্পর্কে স্যাবাইন বলেন, “নীতিগতভাবে রাষ্ট্র কেমন হওয়া উচিত
প্লেটো সেটিই দেখাতে চেয়েছেন। রাষ্ট্রের বাস্তব অবস্থা যদি নীতিভিত্তিক না
হয় তবে তা বাস্তব
অবস্থার ত্রুটি।“
প্লেটো দেখিয়েছেন যে, মানুষের মধ্যে
তিন ধরনের উপাদান রয়েছে। এগুলো হল- যুক্তি, সাহস
ও কামনা। মানব ব্যক্তিত্ব্যের এই
তিন ধরনের উপাদানের উপর ভিত্তি করে
তিনি তিনটি সামাজিক শ্রেণীর কথা বলেছেন:
শাসক
শ্রেণী (Philosopher-kings):
এরা হবেন মানব মনের
যুক্তি দ্বারা চালিত গোষ্ঠী। এদের থাকবে ধৈর্য্য,
মেধা বা প্রজ্ঞা। এই
শ্রেণীর অর্ন্তভূক্ত দার্শনিক-রাজা, জ্ঞানী ও ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তিরা
যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করবে।
রক্ষক
শ্রেণী (Guardians):
এই
শ্রেণীর লোক পারিচালিত হবেন
সাহস দ্বারা। সাহসী ও শক্তিশালী ব্যক্তিরা
যারা রাষ্ট্রকে রক্ষা করবে। সৈনিক, রক্ষী বা পাহাড়াদার এই
শ্রেণীর অর্ন্তভূক্ত।
উৎপাদক
শ্রেণী (Producers):
এরা কামনা দ্বারা পরিচালিত। কৃষক, কারিগর, শিল্পী, ব্যবসায়ী ইত্যাদি যারা রাষ্ট্রের অর্থনীতির
ভার বহন করবে।
প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের সকল শ্রেণীর জন্য
শিক্ষা বাধ্যতামূলক । তিনটি শ্রেণীর
মধ্যে কে কোন শ্রেণীভূক্ত
হবেন তার জন্য তিনি
স্তর ভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থার কথা বলেছেন। প্রত্যেক
শ্রেণীর জন্য আলাদা শিক্ষা
ব্যবস্থার প্রস্তাব করেছিলেন।
উৎপাদক
শ্রেণী : প্রথম স্তরের অকৃতকার্যরা উৎপাদক শ্রেণীভূক্ত হবেন। তাদের শিক্ষার পরবর্তী বিষয় থাকবে ব্যবহারিক
জ্ঞান।
রক্ষক
শ্রেণী : দ্বিতীয় স্তরের অকৃতকার্যরা হবেন রক্ষক শ্রেণীভূক্ত
। এদের শিক্ষা হবে
শারীরিক ও সামরিক প্রশিক্ষণ।
শাসক
শ্রেণী : সর্বোচ্চ স্তরে যারা সাফল্য লাভ
করবেন তারা হবেন শাসক
শ্রেণী। উচ্চতর জ্ঞান, দর্শন, ন্যায়বিচার তাদের শিক্ষার বিষয়।
প্লেটো নারী-পুরুষের সমতার পক্ষে ছিলেন এবং তাদের জন্য সমান শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রের সুযোগের কথা বলেছিলেন। নারীরাও রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশগ্রহণ করতে পারবে। নারী ও পুরুষের জন্য সমান অধিকার ।
শাসক ও রক্ষক
শ্রেনীর ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার থাকবে না। উৎপাদকদের কিছুটা
ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার থাকবে, তবে তা নিয়ন্ত্রিত
ছিল।
পরিবার:
প্লেটো ঐতিহ্যবাহী পরিবার ব্যবস্থার সমালোচনা করেছিলেন। তিনি মনে করতেন,
শিশুদের রাষ্ট্রের দায়িত্বে বড় করা উচিত,
যাতে তারা রাষ্ট্রের প্রতি
আনুগত্যশীল ও ন্যায়পরায়ণ হয়ে
ওঠে। শাসক ও রক্ষক
শ্রেনীর ব্যক্তিগত কোনো নির্দিষ্ট বা
স্থায়ী স্ত্রী বা পরিবার থাকেব
না। তাঁরা ব্যারাকে থাকবেন, একত্রে খাবেন, বিশেষ ব্যবস্থায় সাময়িকভাবে সেখানকার নারী-পুরুষ মিলিত
হয়ে শারীরিক চাহিদা মেটাবেন, ফলে এমন মিলনে
যে সন্তান জন্ম নেবে তা
নির্দিষ্ট কারো সন্তান বলে
চিহ্নিত করা যাবে না।
সন্তান রাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে লালিত-পালিত হবেন।
প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্র চিন্তার যেটি খুব সূক্ষভাবে
লুকায়িত তা হল-ইউজেনিক্স
তথা শাসক ও রক্ষক
শ্রেনীদেরকে উন্নত বংশধর উৎপাদনের জন্য নিয়ন্ত্রণ।
প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি হল
ন্যায়বিচার। শাসক ও রক্ষক
শ্রেনীর ব্যক্তিগত কোনো পরিবার বা
স্ত্রী-সন্তান না থাকায় দুর্নীতি
ও স্বজনপ্রীতির সুযোগ থাকবে না। রাষ্ট্রের প্রতিটি
নাগরিকের কর্তব্য নির্ধারণ করা হয় তাদের
স্বভাব ও দক্ষতার ভিত্তিতে,
যাতে প্রত্যেকে সমাজের উন্নয়নে অবদান রাখতে পারে।
প্লেটো ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিরোধী ছিলেন। তিনি মনে করতেন,
রাষ্ট্রের সকল সম্পত্তি রাষ্ট্রের
মালিকানাধীন হওয়া উচিত এবং সকল
সদস্যের মধ্যে সমানভাবে ভাগ করে দেওয়া
উচিত। প্লেটো অতি সাবধানীর মতো
শাসক ও রক্ষক শ্রেনীর
জন্য এক ধরনের সাম্যবাদী
জীবন ব্যবস্থার কথা বলেছেন। তাদের
কোনো ব্যক্তিগত পরিবার বা সম্পত্তি থাকবে
না বলে সমাজের সকল
স্তরের মানুষের মধ্যে সম্পদের সমতা থাকবে।
প্লেটো কলার কিছু শাখাকে
রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর মনে
করতেন। তিনি মনে করতেন,
কবিতা ও সঙ্গীত মানুষের
আবেগকে উত্তেজিত করে, যা রাষ্ট্রের
স্থিতিশীলতার জন্য ক্ষতিকর।
প্লেটো ধর্মের গুরুত্ব স্বীকার করেছিলেন। তিনি ধর্মকে রাষ্ট্রের
একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচনা
করতেন। তিনি মনে করতেন,
ধর্ম মানুষকে নীতিবান ও সৎ হতে
সাহায্য করে। ধর্ম মানুষকে
ন্যায়পথে পরিচালিত করতে পারে।
প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্র নানাভাবে সমালোচিত হয়েছে। উল্লেখযোগ্য সমালোচনাগুলো হলো:
আইনের প্রতি অবজ্ঞা: প্লেটোর
আদর্শ রাষ্ট্রের শাসকেরা নিজেদের জ্ঞান, বুদ্ধি, বিবেচনা দিয়ে শাসন করেন।
তারা কোনো নির্দিষ্ট আইন
দ্বারা আবদ্ধ না, ফলে স্বৈরাচার
বা স্বৈরশাসনের সুযোগ থাকে। এরিস্টটল বলেছেন, ব্যক্তির শাসনের চেয়ে আইনের শাসন
সব সময় উত্তম।
No comments