বিচার বিভাগের স্বাধীনতা: সংজ্ঞা ও রক্ষার উপায়
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা: সংজ্ঞা ও রক্ষার উপায়
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বলতে বোঝায় নির্বাহী ও আইনবিভাগের হস্তক্ষেপ ছাড়াই বিচার বিভাগের ন্যায়বিচার প্রদানের ক্ষমতা। এর অর্থ হল বিচারকরা কোনো ভয়, পক্ষপাত বা প্রভাব ছাড়াই তাদের বিচারিক বিবেচনা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। অন্যভাবে, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বলতে বোঝায়, রাষ্ট্রের অন্যতম স্তম্ভ হিসেবে বিচার বিভাগের অন্য কোনো ক্ষমতা, ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের প্রভাব বা হস্তক্ষেপ থেকে মুক্তভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করার ক্ষমতা, অর্থ্যাৎ আইন অনুসারে ন্যায্য বিচার প্রদান করার ক্ষমতা।
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষার উপায়সমূহ:
- সংবিধানে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য স্পষ্ট ও নির্দিষ্ট বিধান থাকা আবশ্যক।
- বিচারকদের নিয়োগ, বরখাস্ত, পদোন্নতি, বেতন-ভাতা ইত্যাদি বিষয়ে সুস্পষ্ট নীতিমালা থাকতে হবে।
- বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ করা।
- বিচারকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য আইন প্রণয়ন করা।
- বিচার বিভাগের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য আইন প্রণয়ন করা।
- বিচারকদের নিয়োগের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা।
- নিয়োগের জন্য যোগ্যতাসম্পন্ন ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের নিয়ে একটি স্বাধীন কমিশন গঠন করা।
- বিচারকদের জন্য নিরাপত্তা ও স্থায়িত্ব নিশ্চিত করা।
- তাদের পদাবধি নির্ধারিত থাকবে এবং তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে অপসারণ করা যাবে না।
- বিচার বিভাগের জন্য পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ নিশ্চিত করা।
- বিচার বিভাগের জন্য পর্যাপ্ত আর্থিক বরাদ্দ এবং প্রয়োজনীয় জনবল নিশ্চিত করা।
- আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিচারিক কার্যক্রম দ্রুত ও সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা।
- বিচারপতিগণকে এ অধিকার দিতে হবে যাতে তাঁরা অপরাধীগণকে তাদেঁর সামনে হাজির করাতে পারেন।
- বিচারকার্য তথা আদালতের গুরুত্ব জনসমক্ষে তুলে ধরতে পারেন।
- আদালতের রায় কার্যকরণে বিচারকগণকে ক্ষমতা প্রদান।
- বিচারকদের নিরপেক্ষ ও সাহসী হতে হবে।
- তাদের বিচারিক বিবেচনা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
- কোনো ভয়, পক্ষপাত বা প্রভাবের কাছে নতি স্বীকার করা যাবে না
- বিচার বিভাগের স্বাধীনতার গুরুত্ব সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা।
- বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষায় সকলের ভূমিকা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা।
- বিচার বিভাগের কার্যক্রম সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করার জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা।
- বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য সুশীল সমাজের সক্রিয় ভূমিকা পালন করা।
- অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া।
- সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যমের পক্ষ থেকে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষায় সহায়তা করা।
- বিচার বিভাগের জন্য আধুনিক অবকাঠামো ও প্রযুক্তি সরবরাহ করা।
- বিচার বিভাগের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণ প্রদান করা।
- আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী বিচার বিভাগের উন্নয়ন নিশ্চিত করা।
জাতীয় বিচারিক কাউন্সিল: বিচারকদের নিয়োগ, বহাল রাখা এবং অপসারণের জন্য একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান।
জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন: নিম্ন আদালতের বিচারকদের নিয়োগ, বহাল রাখা এবং অপসারণের জন্য একটি প্রতিষ্ঠান।
আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক): বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান।
উপরিউক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা সুসংহত ও সুদৃঢ় করা গেলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষায় তা বিশেষভাবে কার্যকর হবে।
বাংলাদেশের সংবিধানে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ধারণা:
- বাংলাদেশের সংবিধানের 116ক অনুচ্ছেদ অনুসারে, "এই সংবিধানের বিধানাবলী সাপেক্ষে বিচার-কর্ম বিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিগণ এবং ম্যাজিস্ট্রেটগণ বিচারকার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকবেন।"
- 22 অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, "রাষ্ট্রের নির্বাহী অঙ্গসমূহ হইতে বিচারবিভাগের পৃথকীকরণ রাষ্ট্র নিশ্চিত করিবেন৷"
বিচার বিভাগের স্বাধীনতার গুরুত্ব:
- আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য: আইনের শাসন বলতে বোঝায় আইনের সামনে সকলের সমতা। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে যে আইন সকলের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য এবং কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়।
- মানবাধিকার রক্ষার জন্য: বিচার বিভাগের স্বাধীনতা মানবাধিকার রক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
- সুষ্ঠ ও নিরপেক্ষ বিচার প্রদানের জন্য: বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে যে সকল মামলা সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে বিচার করা হবে।
- গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার জন্য: বিচার বিভাগের স্বাধীনতা গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করে কারণ এটি নিশ্চিত করে যে সরকার আইনের অধীনে কাজ করছে।
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য বিচার বিভাগের স্বাধীনতা অপরিহার্য। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষা একটি অবিরাম প্রক্রিয়া। এটি রক্ষার জন্য সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।
No comments