Header ads

পথের পাঁচালী উপন্যাস অবলম্বনে অপু চরিত্রের ক্রমবিকাশ আলোচনা কর ।। Apu's character in "Pather Panchali"

পথের পাঁচালী উপন্যাস অবলম্বনে অপু চরিত্রের ক্রমবিকাশ আলোচনা কর ।। Apu's character in "Pather Panchali"

অপু: এক মহাজীবনের নায়ক

বাংলা সহিত্যে জীবনের অবক্ষয় আর সংশয় জিজ্ঞাসার পটভূমিতে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের(১৮৯৪-১৯৫০) আবির্ভাব। সাহিত্যের আকাশে তখন ভরে উঠেছে নতুন সমাজ চেতনায়, বিচিত্র বাস্তব জীবন সমস্যায়- সেই মুহূর্তে বিভূতিভূষণ নিয়ে এলেন এক শান্ত নির্লিপ্ত সুরের নির্জন অবকাশ "পথের পাঁচালী"(১৯২৯) উপন্যাস যা বাঙালি জীবনের যথার্থই এপিক(Epic)। পল্লির নির্জন পথে ধু ধু করা উধাও মাঠে গহন রাত্রির নিঃসঙ্গ আকাশের তলায়, সহজ শান্ত জীবনের আবেগমথিত গভীর সুরগুলো বিভূতিভূষণ তাঁঁর প্রথম উপন্যাসে অতি পরিচিত পটভূমিতে প্রকাশ করলেন নিরলংকার অথচ আশ্চর্য ব্যঞ্জনায়ময় এক ভাষায়। 

    'পথের পাঁচালী'র নায়ক অপু। বিভূতিভূষণ তাঁর সাহিত্যে বিচিত্র ধরনের চরিত্র সৃষ্টি করেছেন। আর এ ধরনের চরিত্রের মধ্যে অপু চরিত্রটি উল্লেখযোগ্য। অপু চরিত্র 'পথের পাঁচালী' উপন্যাসে জন্মগ্রহণ করে ধীরে ধীরে বড় হয়ে 'অপরাজিত' উপন্যাসে এসে জীবনবোধে স্থিত হয়েছে। 

    বাংলা সাহিত্যে এক অবিস্মরণীয় চরিত্র অপু। বিভূতিভূষণের মনে দেশ ও কালের যে বৃহৎ চেতনা আছে, যে অন্তর্নিহিত পথিক সত্তা আছে- সবই অপু চরিত্রের মধ্যে সমন্বিত রূপ লাভ করেছে। 'পথের পাঁচালী' উপন্যাসে অঙ্কিত বাস্তব জীবন-চিত্রের মধ্যেই বিভূতিভূষণ অপুর রোমান্টিক জীবন চেতনার আশ্চর্য ব্যঞ্জনা ফুটিয়ে তুলেছেন। এক কথায় বিভূতিভূষণের সমগ্র শিল্পী সত্তা যেন ওই একটি চরিত্রের মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছে। 

    অপু চরিত্র নতুন মূল্যবোধ ও মহিমা নিয়ে আবির্ভূত। অপু কেবল নীরব মাধুর্য ও অন্তর্মুখী জীবনজিজ্ঞাসা নিয়েই স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়- তার একটি বিশেষ যুগের সন্ধিকালের সাধারণ মানুষের আশা ও প্রত্যাশাকে নতুন ভাষা দিয়ে ক্রমে ক্রমে পরিণত রূপ লাভ করেছে। মূল কথা বিভূতিভূষণ অপু চরিত্রের মধ্য দিয়ে জীবন ভাবনা ও মনুষ্যত্বের মহান মূল্যবোধকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। 

    অপু চরিত্রটি শৈশবে একটি ক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্যে লালিত হয়েও পরবর্তী সময়ে বৃহৎ জগতের সাথে একান্তভাবে অন্বিত হয়েছে। উপন্যাসে প্রথমেই আমরা যে অপুকে দেখতে পাই - সে অপু তার গণ্ডির বাইরের সীমানার আকাঙ্খায় ব্যাকুল। অপুর চরিত্রটি অনুসন্ধিৎসু প্রতিরূপ- তার জানার আকাঙ্খাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছে তার দিদি দুর্গা। নিশ্চিন্দিপুর গ্রামের পথঘাট, বাঁশঝাড়, অরণ্য, আমের বাগান, পুকুর ঘাট, সোনাডাণ্ডার মাঠ সবকিছুই অপুকে আকর্ষণ করেছে। সে তার দিদির সাথে এসব জায়গায় পরিবেশগত রোমান্টিক আবহ আবিষ্কার করেছে। ছোটবেলায় তার বাবার সাথে নীলকণ্ঠ পাখি দেখতে যাওয়া অপু চরিত্রে জানার স্পৃহাকে প্রকাশ করে। তার বাবার সাথে কৃঠির মাঠ দেখতে গিয়ে সবকিছু কৌতুহল ভরা দৃষ্টিতে অবলোকন করেছে।  যেমন- 

    "বালক অবাক হইয়া চারিদিকে চাহিয়া দেখিতেছিল। তাহার ছয় সাত বছর জীবনে এই প্রথম বাড়ি হইতে, এতদূর আসিয়াছে। এতদিন নেড়াদের বাড়ি...,, রানু দিদের বাড়ি ইহাই ছিল তাহার জগতের সীমা। ওই মাঠের পথ ওদিকে বুঝি রূপকথার রাজ্য? "

    ছোটবেলা থেকেই অপু চরিত্রের মধ্যে অভিযাত্রার মানসিকতা দেখতে পাওয়া যায়। শারীরিক ও মানসিক উভয় দিক থেকেই চলমানতার বোধে প্রভাবিত অপু চরিত্রটি উৎকর্ষ লাভ করেছে। অপু বীরুরায়ের দস্যুতা ও তার এডভেঞ্চার থেকে একটা রোমান্টিক সুদূরমুখূ স্বভাব অর্জন করেছে। অপু তার সীমাবদ্ধতার গণ্ডি সবসময় অতিক্রম করতে চেয়েছে। কোনো ভৌগোলিক সীমারেখায় ঔপন্যাসিক তাকে বাধেননি, কিন্তু তার বিকাশের পটভূমি হিসেবে ব্যবহার করেছেন নিশ্চিন্দিপুর গ্রামের ভৌগোলিক পটভূমি। 

    প্রকৃতির সাথে একান্ত বন্ধুত্ব বা একাত্মতা অপু চরিত্রের একটি উল্লেখযোগ্য দিক। তাই অনেক সময় মনে হয় 'পথের পাঁচালী'র প্রকৃতি এবং অপু চরিত্র প্রায় সমার্থক। প্রকৃতির সাথে অপুর শিশু হৃদয়ের যেন এক গোপন নিবিড়, অন্তরঙ্গ ভালোবাসার সৃষ্টি হয়েছিল। প্রকৃতির অতি তুচ্ছ উপকরণ ফুল, ফল, লতা, পাতা, কীটপতঙ্গ সবই তার শিশু মনে অসামান্য সৌন্দর্য মণ্ডিত হয়ে ধরা দিয়েছে। 'পথের পাঁচালী' উপন্যাসে উল্লিখিত আশশ্যাওড়া, ঘেঁটু ফুল, মাকাল লতা, নাটা ফলের বীচি, টুনটুনি পাখি সবই শিশু অপুর মনে নিজের মনগড়া অপার্থিব রূপকথার জগৎ নির্মাণ করেছে। প্রকৃতির প্রভাব পরবর্তী সময়ে তার স্মৃতিভাণ্ডে দার্শনিকতার উত্তীর্ণ হয়েছে। 

    অপুর মধ্যে ছন্নছাড়া স্বাভাবের পরিচয় পাওয়া যায়- এটি উত্তরাধিকার সূত্রে তার বাবা হরিহরের কাছ থেকে প্রাপ্ত। সে তার বাবা হরিহর, মা সর্বজয়া, স্ত্রী অপর্ণা, বন্ধু অনিলের মৃত্যুতে ভারমুক্ত প্রশান্তি লাভ করেছে। তার দিদির মৃত্যুতেও তাকে বিষাদের ছায়া আচ্ছন্ন করেনি, বরং নিজেকে বন্ধনহীন মনে করে কল্পনা জগতে বিচরণ করেছে। মৃত্যু তার কাছে মোহনীয় দৃষ্টিতে ধরা দিয়েছে এবং এরই মধ্য দিয়ে ধাবমান কালের হাত ধরে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে। যেমন-

    "সর্বজয়ার মৃত্যুর পর অপু কিছুকাল এক অদ্ভুত মনোভবের সহিত পরিচিত হলো । চাকরি নিয়ে চলে যায় সে মধ্য প্রদেশের অরণ্য বাসে- যে পথের ডাক অপু শৈশবে শুনেছিল। লেখকের ভাষায়-     

    "পথের দেবতা অদৃশ্য তিলক তার ললাটে পরিয়ে তাকে ঘর ছাড়া করেছে।"

    সংবেদনশীল বালক অপুর যৌন চেতনার অপরিস্ফুট উন্মেষ ঘটেছে বালিকা-কিশোরীদের সংস্পর্শে এসে। তার বাবার শিষ্য লক্ষণ মহাজনের বাড়িতে অমলার সঙ্গে, কাশীতে মেজ বৌরানীর মেয়ে লীলা, ডেপুটি বাবুর মেয়ে নির্মলাকেও তার ভালো লেগেছিল। ঘটনাচক্রে অপর্ণাকে অপু প্রথম যেদিন দেখে; তার মনে পড়েছিল সদ্য পঠিত উপন্যাসের একটি বাক্য- "Do they breed Goddessess at slocum magna." সুতরাং অপু চরিত্রের পূর্ণতা আনয়নে কিশোরী বা নারী চরিত্রগুলো সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছিল। 

    অপুর মধ্যে দুই কালের সংস্কার বিদ্যমান। সে এ যুগের হলেও উত্তরাধিকার সূত্রে সে সেকালের কিছু বৈশিষ্ট্য পেয়েছে। ইন্দির ঠাকরুনের স্মৃতিভাণ্ডারের সে বীরুরায়ের দস্যুতার কাহিনী থেকে কল্পনার রোমান্টিক একটি জগতে প্রবেশ করেছে। তাই অপু আধুনিক কালের মানুষ হয়েও সে ঘাস ফুলের আঘ্রাণে অতীতকে স্মরণ করেছে। 

    অপুর চরিত্রে অভিজাত্যবোধ বিদ্যমান ছিল। সে কারো কাছে ছোট হতে চায়নি। অবশ্য এ গুণটা তার বাবা হরিহরের কাছ থেকে ্পেয়েছে। বাবার স্বভাব তার মধ্যে সৃষ্টিশীলতায় উন্নীত করেছে। সে তার হীনতা দীনতা কারো কাছে প্রকাশ করেনি । উপন্যাসিক অপু চরিত্রকে পরিসুদ্ধ করে সৃষ্টি করেননি। তাই অপুর চরিত্রে দোষ-গুণের সংমিশ্রণ ঘটেছে।

    অপু তার বাবা হরিহরের মতো ধর্ম ভক্ত নয়। সে সংস্কারমুক্ত আধুনিক মনের অধিকারী। অবশ্য সে এক সৃষ্টিকর্তার সত্তাকে স্বীকার করে। অপু চরিত্রের বৈশিষ্ট্যাবলিতে লেখক ইতিবাচকতাকেই বেশি স্থান দিয়েছেন। জীবনের ক্লেদ, পঙ্কিলতা, সংকীর্ণতা, জটিলতা ্প্রভৃতির উর্ধ্বে উঠে অপু চরিত্র বিকাশ লাভ করেছে। কোনো দুঃখ বোধই অপু চরিত্রকে অবরুদ্ধ করতে পারেনি। অর্থ্যাৎ ভারতীয় আনন্দবাদী দর্শনের সাথে একাত্ম করে অপু চরিত্রকে লেখক তিল তিল করে গড়ে তুলেছেন। 

    অপুর মধ্যে লেখাপড়ার কোনো বাছাই ছিল না। সে হাতের কাছে যা পেয়েছে সবকিছুই অকপটে অধ্যয়ন করেছে। এভাবে সে ধীরে ধীরে পাঠের আনন্দ জগতে প্রবেশ করেছে ফলে সমস্ত পৃথিবী তার কাছে একটি পাঠশালা হিসেবে ধরা দিয়েছে। 

    শৈশবের প্রকৃতির আনন্দ, সৌন্দর্যপ্রেম পরবর্তী সময়ে অপু চরিত্রকে দার্শনিকতায় উন্নীত করেছে। অপুর হৃদয় অনন্তহীন মহিমায় ভরে উঠেছে। সমগ্র বিশ্ব প্রকৃতির অন্তর্লোকের মর্মবানী সেও শুনতে পেয়েছে। যেমন- 

    "সে অমর ও অনন্ত জীবনের বনলতা, রৌদ্র শাখা পত্রের তিক্ত গন্ধ আনে - নীল শূন্য বালিহাসের সাঁই সাঁই রব শোনায়...। তার মনে হইল সে জন্ম জন্মান্তরের পথিক আত্মা, দূর কোনো সুদূরের নিত্য নতুন পথহীন পথে তার গতি।" 

    প্রকৃতির মধ্যে সূক্ষ্ম রহস্যময়তা আবিষ্কার অপু চরিত্রের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হিসেবে বিবেচ্য। অপুর জ্যোর্তিময় চেতনা উত্তরণ ঘটানোই লেখকের প্রধান বৈশিষ্ট্য। লেখক সর্বজ্ঞ দৃষ্টিকোণ থেকে তাঁর দার্শনিক সত্তাকে অপুর চত্রের মধ্যে স্থাপন করেছেন। মহাকালের একটি আদি অন্তহীন দিগন্তে মানব চরিত্রের অপরূপ হিসেবে অপুর চরিত্রের উদ্ভব ও বিকাশ। প্রকৃতি ও মহাজাগতিক রহস্য সৃজনশীল অপু চরিত্র গঠনে সহায়তা দান করেছে। 

    জীবন চলমান ও প্রবাহমান। তবে চলমানতার মধ্যেই জীবন সমাপ্ত নয়- মানুষের চলমানতা জন্ম-জন্মান্তরে। চলমানতার দ্বারা যে বৃত্তটি সৃষ্টি হয় তা কখনো থামে না। এটি মৃত্যু এবং জন্মের মধ্য দিয়ে চক্রাকারে ঘুরতে থাকে। অপুর জীবনে চক্রাকার বৃত্তের কিছু অংশ ঔপন্যাসিক তাঁর উপন্যাসে স্থাপন করেছেন। অপু চরিত্রটি বিভূতিভূষণের জীবনাদর্শের স্ফটিক সম্ভূত প্রকাশ। অপু বিকাশশীল চরিত্র। দার্শনিকতার মাহাত্ম্যে জীবনদর্শনের ইতিবাচকতায় অপু সমস্ত বাধা অতিক্রম করে বিকাশ লাভ করেছে- তাই সে অপরাজিত। যেমন-

    "যুগে যুগে অপরাজিত জীবন রহস্য কি অপূর্ব মহিমাকেই আবার আত্মপ্রকাশ করে।"

    অতএব আমরা বলতে পারি, সূক্ষ্ম সংবেদনশীলতা অপু চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য- জীবনের খণ্ডতা ও ক্ষুদ্রতার অন্তহীন মহাকালের মধ্যে যে জীবন ও জগৎ বিসর্পিত অপু নিজেকে সেই মহাবিশ্বের একজন নাগরিক বলে অনুভব করেছে। সুতরাং বলা যায়, শত দুঃখ বেদনা এবং তুচ্ছতার মধ্যে অন্তহীন মহাকাল ও অসীম বিশ্বলোকের পটভূমিতে মানুষের অপরাজিত পথিক সত্তার রূপকল্পই হচ্ছে অপু চরিত্র। 

দুর্গা চরিত্র সম্পর্কে সংক্ষেপে লেখ 

'Durga' character of "Pather Panchali"










ইন্দির ঠাকরুনের পরিচয় দাও  

'Indir Thakurun' from 'Pather Panchali'



No comments

Theme images by Maliketh. Powered by Blogger.