চোখের বালি উপন্যাস অবলম্বনে বিনোদিনী চরিত্র বিশ্লেষণ কর ।। The character of 'Binodini' in 'Chokher Bali'
'চোখের বালি' উপন্যাস অবলম্বনে বিনোদিনী চরিত্র বিশ্লেষণ কর।
'চোখের বালি' উপন্যসের বিনোদিনী চরিত্রের স্বরূপ বিচার কর।
ভূমিকা: বাংলা উপন্যাসের ধারায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের(১৮৬১-১৯৪১) 'চোখের বালি'(১৯০৩) উপন্যাসটি এক অভিনব সংযোজন। 'চোখের বালি' মনস্তত্ত্বমূলক কাহিনি বিন্যাসে কার্যকারণ-শৃঙ্খলা আরোপ ও উনিশ শতকীয় ঘটনাধর্মিতা পরিহারে এক অসামান্য সৃষ্টি। এ উপন্যাসটিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সর্বপ্রথম ব্যক্তিত্ব ও অস্তিত্ব সজাগ চরিত্র নির্মাণ করেছেন। যাদের মধ্যে সর্বাধিক চিত্তাকর্ষক ও গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হলো বিনোদিনী। উপন্যাসের কাহিনি বা ঘটনার ক্রমবিকাশ এবং কাহিনির জটিলতা আবর্তে যেসব চরিত্র সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে তাদের মধ্যে বিনোদিনী চরিত্রটি অন্যতম।
বিনোদিনী চরিত্রের স্বরূপ: 'চোখের বালি' মূলত চরিত্র নির্ভর উপন্যাস। চরিত্রগুলোর নানা মানসিক দ্বন্দ্ব জটিলতা উপন্যাসটিকে একটি পরিণামের দিকে টেনে নিয়ে গিয়েছে। ব্যাক্তিস্বতন্ত্র্যবোধ এ উপন্যাসের প্রধান দিক হিসেবে ফুটে উঠেছে। এ উপন্যাসে ঘটনা চরিত্র সৃষ্টি করেনি, চরিত্রই ঘটনা সৃষ্টি করেছে। আর এর কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করেছে বিনোদিনী। বিনোদিনীর নানা মানসিক জটিলতা এ উপন্যাসের অন্যান্য চরিত্রকে সক্রিয় ও চালিত করেছে।
অপরাপর ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজ প্রথার মধ্যে বিনোদিনী কীভাবে উপেক্ষিত, বঞ্চিত, বিকৃত ও মহৎ হয়ে উঠেছে তার স্বরূপ অঙ্কনে রবীন্দ্রনাথ অধিকতর উৎসাহী ছিলেন। বিনোদিনী আত্মসচেতন, অস্তিত্বকামী, দূর-দৃষ্টিসম্পন্ন চরিত্র হিসেবে 'চোখের বালি' উপন্যাসে চিত্রিত হয়েছে। মহেন্দ্র - আশার সুখময় সংসারে বিনোদিনীর প্রবেশের পূর্বকাল পরিসর প্রথম পর্যায়ে বিবেচনা করা যেতে পারে। বিনোদিনীর সমগ্র অন্তরশক্তি, জীবনতৃষ্ণা, ব্যক্তিত্ব সচেতনতা, অস্তিত্ব চেতনার দৃঢ়মূল এ অংশে প্রোথিত । উপন্যাসের প্রথম পরিচ্ছেদেই দেখা যায় রাজলক্ষ্মী মহেন্দ্রের সঙ্গে বিনোদিনীর বিয়ে দিতে চায়। উপন্যাসে রাজলক্ষ্মীকে বিনোদিনী সম্পর্কে বলতে শোনা যায়- "শুনিয়াছি মেয়েটি বড়ো সুন্দরী, আবার মেমের কাছে পড়াশুনাও করিয়াছে।" উদ্ধৃতির মধ্য দিয়ে বিনোদিনীর শিক্ষিত , ব্যক্তিচেতনা ও আত্মমর্যাদাবোধের পরিচয় পাওয়া যায়। কিন্তু এ সুশিক্ষিত মেয়েটিকে বিয়ে করতে অস্বীকৃতি জানায় মহেন্দ্র। ফলে বিনোদিনী তার অর্জিত মনোভাব, স্বপ্ন, কল্পনা এবং জীবনার্থচ্যুত হয়ে গ্রামীণ পরিবেশে হয় আগন্তুক। বারাসাতে তার বিয়ে হওয়ার অল্পকাল পরেই সে বৈধব্যবরণ করল। লেখকের ভাষায়-
"তাহার (স্বামীর) মৃত্যুর পর হইতে বিনোদিনী জঙ্গলের মধ্যে একটি মাত্র উদ্যালতার মতো নিরানন্দ পল্লির মধ্যে মুহ্যমানভাবে জীবনযাপন করিতেছিল।"
বিনোদিনীর এ একটিমাত্র অবস্থানেই তার চরিত্রের সকল সৌন্দর্য ফুটে উঠেছে। অকাল বৈধব্যের নিঃসীম বেদনা নিয়ে বিনোদিনীর আবির্ভাব বিচ্ছিন্ন ও এককভাবে নয় ঘটনাবৃত্তের একবারে মধ্যস্থরে তার অবস্থান। সপ্তম পরিচ্ছেদে আমরা দেখি বিনোদিনী রাজলক্ষ্মী ও বিহারীর সংস্পর্শে এসে অস্তিত্ব সচেতন হয়ে ওঠে। বিশেষত বিহারীকে লেখা মহেন্দ্রের চিঠি পড়ে তার লুপ্তপ্রায় নারীহৃদয় পুনরায় জেগে ওঠে। যেমন-
"চিঠির মধ্যে বিনোদিনী কী রস পাইল, তাহা বিনোদিনীই জানে কিন্তু তাহা কৌতুক রস নহে। বার বার পড়িতে পড়িতে তাহার দুই চক্ষু মধ্যাহ্নের বালুকার কতো জ্বলতে লাগল, তাহার নিঃশ্বাস মরুভূমির বাতাসের মতো উত্তপ্ত হইয়া উঠিল।"
নিঃশ্বাস, একাকিত্ব দারিদ্র্য ও পল্লিগ্রামের নিস্তরঙ্গ দুঃখি জীবন থেকে রাজলক্ষীল হাত ধরে বিনোদিনী চলে আসে মহেন্দ্র আশা ও রাজলক্ষ্মীর জীবনবৃত্তে। এখান থেকেই তার চরিত্রের দ্বিতীয় পর্যায় শুরু। মহেন্দ্রের সঙ্গে তার বিবাহ না হওয়ার বেদনা কখনো আশার অপটুতায় ঈর্ষাণ্বিত করেছে। কখনো বা অন্তরের জ্বালায় মহেন্দ্র-আশার স্বপ্নময় জীবনের প্রতি আসক্ত হয়ে উঠেছে। বিনোদিনী বাল্যবিধবা। তার রূপ আছে, গুণ আছে, আছে দেহ ভরা যৌবন। সে শিক্ষিতা, মার্জিত রুচিসম্পন্ন। অন্যান্য বাঙালি নারীদের থেকে সে একটু বেশিই শিক্ষিত ছিল। কারণ তার বাবা মেম রেখে তাকে লেখাপড়া শিখিয়েছিল। কিন্তু বিধবা হয়ে আশ্রিতার জীবন গ্রহণ করেছে মহেন্দ্রের গৃহে। সে সংসারে সেবাদাসীর কাজ করে তার গ্রাসাচ্ছাদন চলবে এ ছিল তার ভরসা। কিন্তু সমস্যা সৃষ্টি হয় আশাকে নিয়ে। আশা বালিকা, তার রূপ থাকলেও নেই তাতে দাহিকাশক্তি: অন্তর থাকলেও তার বৃত্তির অনুশীলন হয়নি। শিক্ষা যার বর্ণ পরিচয়ের গণ্ডিতে আবদ্ধ। সে কি না বিনোদিনীর রূপ গুন সব ব্যর্থ করে দিয়ে ধনীগৃহের স্বামী সোহাগিনী হলো। আর এ বস্তু ভোগ থেকে বঞ্চিত হলো বিনোদিনী। বিনোদিনী বুদ্ধিমতী ও কর্মনিপুণা।
বিনোদিনীর অতৃপ্ত প্রেমাকাঙ্খা ও বঞ্চিত জীবনের দীর্ঘশ্বাস তাকে উৎসারিত করল জীবনকে নতুনভাবে উপলব্ধি করতে। ফলে সে নবজাগতিক প্রেমানুভূতির পরিতৃপ্তি খোজেঁ মহেন্দ্রের আশ্রয়ে। মহেন্দ্রের প্রতি তার আকর্ষণ যতো না প্রণয়গত, ততোধিক আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য। এক সময় মহেন্দ্রের উদাসীনতাকে লক্ষ্য করে বলতে শোনা যায় _
"এত ঔদাসীন্য কীসের। আমি কি জড়পদার্থ। আমি কি মানুষ নই। আমি কি স্ত্রীলোক নই। একবার যদি আমার পরিচয় পাইত, তবে আদরের চুনির সঙ্গে বিনোদিনীর প্রভেদ বুঝিতে পারিত।"
এরপর সেবাশুশ্রুষা, পরিচর্যা প্রভৃতির মাধ্যমে বিনোদিনী ধীরে ধীরে মহেন্দ্রকে আকর্ষণ করে। বিনোদিনীর কাছে মহেন্দ্র পরাজয় স্বীকার করে। যেমন -
"বিনোদিনীতে ভারি ভুল বুঝিয়াছিলাম, সেবায় সান্তনার নিঃস্বার্থ সখী প্রেমে সে মর্তবাসিনী দেবী'।
মূলত এ অংশ থেকেই কাহিনি জটিল আকার ধারণ করে। মহেন্দ্র যে তার অন্তরে কীসের জ্বালা জ্বালিয়েছে তা সে খুজেঁ পায় না। বিনোদিনীর জবানীতে লেখক তা অন্তর্জ্বালার দিকটিকে চিত্রিত করেছেন এভাবে - 'আমি মরতে চাই কি মারিতে চাই, তাহা বুঝিতে পারিলাম না"।
নিজেকে না বোঝার এ দ্বন্দ্ব রবীন্দ্রনাথ পূর্বে কোনো চরিত্রের মধ্য দিয়ে অঙ্কন করেননি। বিনোদিনীর মধ্যে যে দ্বৈতসত্ত্বা বিরাজ করছিল তা প্রথম অনুধাবন করে বিহারী। লেখকের ভাষায়-
"বিহারী এটুকু বুঝিয়াছে, এ নারী জঙ্গলে ফেলিয়া রাখিবার নহে। কিন্তু শিখা একভাবে ঘরের প্রদীপ রূপে জ্বলে, আর একভাবে ঘরে আগুন ধরাইয়া দেয়।"
উপন্যাসের সতেরো সংখ্যক পরিচ্ছেদের অন্তর্গত দমদমের বাগানে চড়ুইভাতি বিনোদিনীর জীবনের একটি নিগূঢ় ঘটনা। এখান থেকেই তার পালাবদল আরম্ভ এবং তার চরিত্রের তৃতীয় পর্যায় আরম্ভ। দমদমের চড়ুইভাতির পূর্বে বিহারীর প্রতি বিনোদিনীর সতর্ক দষ্টি ছিল কিন্তু অনুরাগ ছিল না। এরপর বিহারীর প্রতি তার অনুরাগ জন্মায়। কিন্তু বিহারীর ঔদাসীন্য তার হৃদয়ের সহজ বিকাশকে ব্যাহত করে। যেমন -
'একেবারে পাথরের দেবতার মতো পবিত্র হইয়োনা, মন্দকে ভালোবাসিয়া একটু মন্দ হও ঠাকুর পো।'
একদিকে বিনোদিনী মহেন্দ্রের ওপর আধিপত্য বিস্তার করে জুঝতে পারে এ পুরুষ নারীকে পরিতৃপ্ত করার উপযোগী নয়। অপরদিকে বিহারী তার হৃদয়বোধকে মর্যাদা দেওয়ার যোগ্য ব্যক্তি বলে তার মনে হয়। বিনোদিনীর জীবনের এ দ্বৈত সত্তাই তার জীবনের ট্রাজেডি।
বিনোদিনীর অতৃপ্ত হৃদয় বেদনাই উপন্যাসকে আরো বেগবান করেছে। একদিকে মহেন্দ্রকে পীড়ন অন্যদিকে বিহারীকে পাওয়ার প্রত্যাশা অনুভব করে বিনোদিনী। অর্থাৎ তার অন্তর যে আগুন প্রজ্জ্বলিত হয়ে উঠেছে তা থেকে রক্ষা করতে পারে একমাত্র বিহারী। তাই আর্তকন্ঠে বিনোদিনীকে বলতে শোনা যায়-
'আমার জীবন শূন্য, আমার হৃদয় শূন্য , আমার চতুর্দিক শূন্য - এই শূন্যতার মাঝখানে একবার তুমি এসো, এক মুহূর্তের জন্যে এসো, তোমাকে আসতেই হবে।'
বিনোদিনীর জীবনের সমস্ত বেদনাবোধ ও পুনরাকাঙ্ক্ষা যেন এখানে মূর্ত হয়ে উঠেছে। যেমন -
'জীবন সর্বস্ব জানি তুমি আমার চিরকালের নও, কিন্তু আজ এক মুহূর্তের জন্যে আমাকে ভালোবাস।'
উপন্যাসের প্রথমাংশে বিনোদিনীর যে দীপ্তিময় দাহ শেষ পর্বে এসে তার অবসান ঘটে। তার সাধনার চূড়ান্ত পরিণামরূপে বিহারী তাকে বিয়ে করার প্রস্তাব করে। কিন্তু বিনোদিনী এতে গার্হস্থ্য জীবনে শান্তির ছবি দেখতে পেল না তাই সে বলেছে-
"আমি বিধবা আমি নিন্দিতা, সমস্ত সমাজের কাছে আমি তোমাকে লাঞ্চিত করিব, এ কখনোই হতে পারে না।"
এ ছাড়া বিহারীর বিয়ের স্বীকৃতিতে বিনোদিনীকে বলতে শোনা যায়- "এ আমার শেষ পুরষ্কার হইয়াছে।'
শেষে অন্নপূর্ণার সঙ্গে বিনোদিনী সব ত্যাগ করে কাশিতে চলে যায়, লেখক এ চরিত্রের মধ্যে দিয়ে 'ভোগে সুখ নয় ত্যাগের মাধ্যমেই জীবনের সুখ ও পূর্ণতা লাভ করা যায়' এ দর্শনকেই তুলে ধরেছেন।
বিনোদিনী চরিত্রের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে সে অসতী নয়, আত্ম বিকৃতিতে তার অনুরাগ নেই। বিরুদ্ধ পারিপার্শ্বিকতায় তার অতৃপ্ত নারী জীবনের দীর্ঘশ্বাস ধ্বনিত হয়েছিল সত্য কিন্তু কখনোই তাকে আত্মবিস্মৃত হতে দেখা যায় নি। অন্যদিকে বিনোদিনী চরিত্রে দুই রূপ দেখা যায়। একটি বহির্মুখী রূপ- যার প্রধান আশ্রয় মহেন্দ্র। আর একটি অন্তমুখী রূপ- যার প্রধান আশ্রয় বিহারী।
উপসংহার: 'চোখের বালি' উপন্যাসে বিনোদিনীর যে সংকট তা কেবল হৃদয় বৃত্তির সংকট নয়- তার ব্যক্তিত্ব ও অস্তিত্ত্বের সংকট। স্বীয় অস্তিত্ত্বের জন্যে সে বাধ্য হয় তার সজ্ঞান ও নির্জ্ঞান সত্তার সদা সতর্ক অধ্যবসায়ী ও পরিবর্তনশীল হতে। ব্যক্তিচেতনার অঙ্গীভূত দ্বৈতই বিনোদিনী চরিত্রের অন্তর্দ্বন্দ্ব ও তার পরিণতির নেপথ্য আবহ।
কালিদাসের 'মেঘদূত' কাব্যের যক্ষপ্রিয়া চরিত্রের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দাও Yakshapriya in Kalidasa's 'Meghdoot' |
মেঘদূত কাব্যের যৌনতার বিষয়গত সার্থকতা আলোচনা কর Sexuality in 'Meghdoot' poetry |
জোকাস্টা কে? 'ইডিপাস' নাটক অবলম্বনে জোকাস্টা চরিত্রের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দাও Jocasta: A tragic woman in the play 'Oedipus' |
No comments