'মুখরা রমনী বশীকরণ' নাটকের ক্যাথরিনা চরিত্র: এক মুখরা রমনীর রূপান্তরগাথা ।। Katherina: The Taming of the Shrew
মুখরা রমনী বশীকরণ: ক্যাথেরিনার রূপান্তর
উইলিয়াম শেক্সপিয়ার রচিত 'The Taming of the Shrew' নাটকের বাংলা অনুবাদ 'মুখরা রমণী বশীকরণ'-এর মাধ্যমে মুনীর চৌধুরী বাংলা সাহিত্যে এক অসাধারণ নারী চরিত্রকে তুলে ধরেছেন। ক্যাথেরিনা - এই চরিত্রটি কেবল তার কর্কশতা ও বিদ্রোহী মনোভাবের জন্যই নয়, বরং তার চরিত্র বিকাশের জন্যও সমালোচকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। মুখরা রমনী বশীকরণ" নাটকের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ক্যাথেরিনা - একটি জটিল ও বহুমুখী চরিত্র। ক্যাথেরিনা একজন তেজস্বী, স্বাধীনচেতা নারী যাকে 'মুখরা রমণী' বা 'বদ' বলে অভিহিত করা হয়। নাটকের শুরুতে আমরা দেখতে পাই রুক্ষ, বিদ্রোহী, তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, তীব্র স্বাধীনচেতা এবং পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নিয়মকানুনকে প্রত্যাখ্যানকারী ক্যাথেরিনাকে। তার এই স্বভাবের জন্য তাকে 'শ্রু' (shrew) অভিধায় অভিহিত করা হয় এর জন্য সে সমাজে তীব্র নিন্দা ও বিদ্বেষের শিকার, তাকে কেউ বিয়ে করতে চায় না। তার তুখোড় ব্যক্তিত্ব, আবেগের তীব্রতা এবং ভেতরে ভেতরে ভালোবাসার ক্ষুধা তাকে এক অসাধারণ নারী চরিত্রে পরিণত করেছে।
তবে, নাটকের অগ্রগতির সাথে সাথে আমরা দেখতে পাই যে ক্যাথেরিনার চরিত্রে একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসে। তাইতো নাটকের শুরুতে যে নারী কর্কশ 'মুখরা' তারই মুখে নাটকের শেষাংশে শুনতে পাই,
"উত্তেজিত রমনী ঘোলাটে নালার পানির মতো। অসুন্দর, অস্বচ্ছ, ক্লেদাক্ত। যত পরিশ্রান্ত আর পিপাসার্ত হোক না কেন কেউ তার এক গণ্ডুষ পান করবে না, এক বিন্দু স্পর্শ করবে না।"
এই পরিবর্তনকে এক কথায় 'বদ' থেকে 'ভালো' হিসেবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। বরং, এটি একটি জটিল প্রক্রিয়া যা বিভিন্ন পর্যায়ের মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হয়।
ক্যাথেরিনা চরিত্রের কিছু বিশেষ দিক তুলে ধরা হল-
ক্যাথরিনার প্রারম্ভিক চরিত্র: ক্যাথরিনা ধনী ব্যবসায়ী ব্যাপ্তিস্তার বড় মেয়ে। আমরা ক্যাথেরিনাকে দেখতে পাই এক কর্কশ, বিদ্রোহী ও অমান্যশীল নারী হিসেবে। তার পিতা ব্যাপ্তিস্তা, বোন বিয়াঙ্কা এবং অন্যান্য চরিত্রের সাথে তার আচরণ স্পষ্ট করে তার তীব্র মেজাজ ও অসন্তুষ্টি। ক্যাথেরিনার তীব্র রাগ, ঔদ্ধত্য, বিদ্রোহী মনোভাব, সমাজের রীতিনীতি ও পুরুষ কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের কারণে তার বিয়ের বাজারে সমস্যা দেখা দেয়।
উচ্চাভিমানী ও বদমেজাজী: ক্যাথেরিনা একজন তীক্ষ্ণবুদ্ধি সম্পন্ন, উচ্চাভিমানী ও বদমেজাজী নারী। সমাজের রীতিনীতি ও পুরুষ কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে তার প্রবল বিদ্বেষ ও প্রতিবাদী মনোভাব তাকে অন্যদের থেকে আলাদা করে তোলে।
স্বাধীনচেতা, বিদ্রোহী ও সাহসী: ক্যাথেরিনা একজন স্পষ্টবাদী এবং স্বাধীনচেতা নারী। সে সমাজের রীতিনীতি ও পুরুষ কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী নারীর প্রতীক। তিনি পুরুষতান্ত্রিক সমাজের শৃঙ্খল ভাঙতে চান। সমাজের প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও নিজের মতামত প্রকাশ করতে ভয় পান না।
বুদ্ধিমতী, দক্ষ ও বিদ্রুপাত্মক: ক্যাথেরিনা শুধুমাত্র সাহসী ও বিদ্রোহী নন, বরং বুদ্ধিমতী ও দক্ষও বটে। পেট্রুশিওর খেলায় সে বুদ্ধিদীপ্তভাবে জবাব দেয়। তিনি তার তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তা ও বিদ্রুপাত্মক বক্তব্যের মাধ্যমে পুরুষদের প্রতি তার অসন্তোষ প্রকাশ করেন।
তীব্র আবেগপ্রবণ ও অনুভূতিপ্রবণ: ক্যাথেরিনা তার আবেগে তীব্র ও উচ্ছ্বল। সে দ্রুত রাগান্বিত হয় ও তীব্র আবেগ প্রকাশ করে। রাগ, ঈর্ষা, এবং ভালোবাসার মতো অনুভূতিগুলো সে তীব্রভাবে অনুভব করে।কঠোর বহিঃআবরণের ভেতরে লুকিয়ে থাকে ক্যাথেরিনার কোমল ও অনুভূতিপ্রবণ হৃদয়। পেট্রুচিওর প্রতি তার ভালোবাসা এবং মানসিক দ্বন্দ্ব দর্শকদের মনে সহানুভূতি জাগিয়ে তোলে
ভেতরের দ্বন্দ্ব, জটিল ও বহুমুখীতা: বাইরের দিক থেকে কঠোর ও অসহনশীল হলেও, ক্যাথেরিনার ভেতরে লুকিয়ে আছে ভালোবাসার ক্ষুধা ও সঙ্গের প্রয়োজন। তার তীব্র রাগ ও বিদ্রোহের আড়ালে লুকিয়ে আছে একাকীত্ব ও হতাশার অনুভূতি। ক্যাথেরিনা একজন জটিল ও বহুমুখী চরিত্র। তিনি শুধুমাত্র একজন "মুখরা রমণী" নন, বরং একজন বুদ্ধিমতী, স্পষ্টবাদী এবং আবেগপ্রবণ নারী যিনি তার স্বাধীনতা ও আত্ম-সম্মানের জন্য লড়াই করেন।
পরিবর্তনশীল: ক্যাথেরিনা সময়ের সাথে সাথে 'বদ' থেকে 'ভালো'তে রূপান্তরিত হয়।
চরিত্রের গুরুত্ব:
'মুখরা রমনী বশীকরণ' নাটকের ক্যাথরিনা চরিত্র বাংলা নাট্যসাহিত্যের এক গুরুত্বপূর্ণ সৃষ্টি। একজন বদমেজাজী, স্বাধীনচেতা নারীর মানসিক পরিবর্তন ও 'আদর্শ' স্ত্রীতে রূপান্তরের চিত্রায়নের মাধ্যমে নাটকটি সমাজের রীতিনীতি ও পুরুষ কর্তৃত্বের প্রশ্ন তুলে ধরে।
ক্যাথেরিনার পরিবর্তনের আপাত কারণ:
নাটকের শুরুতে, ক্যাথেরিনাকে একজন "বদ" নারী হিসেবে দেখানো হয়। সে তার বাবা ও বিয়ের প্রস্তাবকারীদের প্রতি অসভ্য আচরণ করে। কিন্তু নাটকের অগ্রগতির সাথে সাথে, পেট্রুশিওর চাতুর্যপূর্ণ কৌশল ও অধ্যবসায়ের মাধ্যমে ক্যাথেরিনা পরিবর্তিত হতে শুরু করে।
পেট্রুশিওর খেলা ও মানসিক পরিবর্তন: পেট্রুশিও একজন ধনী ও বদমেজাজী পুরুষ। ক্যাথেরিনার 'মুখরা' স্বভাব তাকে আকৃষ্ট করে এবং সে ক্যাথেরিনাকে বিয়ে করে 'বশ' করতে চায়। বিয়ের পর ক্যাথেরিনার তীব্র রাগ ও বিদ্রোহকে দমন করার জন্য পেট্রুশিও ক্যাথেরিনার প্রতি বিভিন্ন 'খেলা' খেলে। খাবার না দেওয়া, ঘুমাতে না দেওয়া, 'কেইট' নামে ডাকা ইত্যাদির মাধ্যমে পেট্রুশিও ক্যাথেরিনাকে 'শান্ত' করার চেষ্টা করে। প্রথমে পেট্রুশিওর খেলাগুলোকে ক্যাথেরিনা চরম ঘৃণা ও বিদ্বেষের চোখে দেখে। কিন্তু ধীরে ধীরে পেট্রুশিওর 'খেলা'র মধ্যে লুকিয়ে থাকা ভালোবাসা ও আন্তরিকতা বুঝতে পারে। আন্তরিকতার প্রভাবে ক্যাথেরিনার মনোভাব পরিবর্তিত হতে শুরু করে। পেট্রুশিওর প্রতি আকৃষ্ট হতে শুরু করে। রাগ ও বিদ্বেষের পরিবর্তে তার মনে জাগ্রত হয় ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা।
পেট্রুশিওর প্রভাব, আত্ম-নিয়ন্ত্রণ ও আত্ম-সচেতনতা: পেট্রুশিও একজন চতুর ও কৌশলী ব্যক্তি। ক্যাথেরিনাকে 'বশ' করার জন্য সে বিভিন্ন কৌশল প্রয়োগ করে। ক্যাথেরিনার সাথে তার লড়াই ও মানসিক দ্বন্দ্ব তাকে ভেতর থেকে পরিবর্তন করে। পেট্রুশিওর শিক্ষার মাধ্যমে ক্যাথেরিনা তার আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে শেখে এবং ধৈর্য ধরতে শেখে। পেট্রুশিওর চালচালিতে হেরে যাওয়ার পর ক্যাথেরিনা নিজের ভুল বুঝতে পারে। সমাজের রীতিনীতি ও পুরুষতান্ত্রিক শৃঙ্খল সম্পর্কে তার ধারণা পরিবর্তিত হয়।
ভালোবাসার শক্তি ও অন্তিম রূপান্তর: পেট্রুশিওর প্রতি ক্রমবর্ধমান ভালোবাসা ক্যাথেরিনার মনকে নরম করে তোলে। সে বুঝতে পারে যে, স্বাধীনতা ও বিদ্রোহের চেয়ে ভালোবাসা ও বোঝাপড়াই সুন্দর। পেট্রুশিওর 'খেলা'র মাধ্যমে ক্যাথেরিনার 'বদ' থেকে 'ভালো'তে রূপান্তর ঘটে। রাগ, ঔদ্ধত্য, বিদ্রোহের পরিবর্তে তার মনে ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, আনুগত্যের জন্ম হয়।
পরিণতি: ক্যাথেরিনা একটি নতুন পরিচয় খুঁজে পায়। সে বুঝতে পারে যে স্বাধীনতা ও নারীর মর্যাদা রক্ষার জন্য পুরুষদের সাথে বিরোধিতা না করে বরং তাদের সাথে সমযোতা করা সম্ভব। সে পেট্রুশিওর প্রতি তার বিদ্বেষ ত্যাগ করে এবং তাকে একজন স্বামী ও সঙ্গী হিসেবে গ্রহণ করে। এই পর্যায়ে ক্যাথেরিনার চরিত্রে প্রজ্ঞা, পরিপক্কতা এবং আত্ম-সচেতনতার ছাপ স্পষ্ট। নাটকের শেষে ক্যাথেরিনা একজন 'আদর্শ' স্ত্রীতে পরিণত হয়। পেট্রুশিওর প্রতি তার ভালোবাসা ও বিশ্বাস প্রতিষ্ঠিত হয়।
পরিবর্তনের তাৎপর্য:
ক্যাথেরিনার চরিত্রের এই পরিবর্তন কেবল তার ব্যক্তিগত বিকাশের প্রতীক নয়, বরং এটি সমাজের প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনও নির্দেশ করে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড বিদ্রোহ থেকে শুরু করে সমজোতা ও সহাবস্থানের দিকে এগিয়ে যাওয়া ক্যাথেরিনার চরিত্রকে আরও বাস্তবসম্মত ও জটিল করে তোলে।
শেক্সপিয়ার সম্ভবত দর্শকদের এই প্রশ্নের উত্তর নিজেদের কাছে খুঁজে পেতে উৎসাহিত করেছিলেন।
ক্যাথেরিনার 'বদ' থেকে 'ভালো'তে রূপান্তরকে কেবল নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করা ঠিক হবে না। বরং, সমাজের লিঙ্গ-ভিত্তিক কাঠামো, নারীর অধিকার, এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের ধারণার সাথে জড়িয়ে এই রূপান্তরকে ব্যাখ্যা করা উচিত।
শেষ কথা:
'মুখরা রমনী বশীকরণ' নাটকের ক্যাথেরিনা চরিত্র বাংলা নাট্যসাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ সৃষ্টি। একজন বদমেজাজী, স্বাধীনচেতা নারীর মানসিক পরিবর্তন ও 'আদর্শ' স্ত্রীতে রূপান্তরের চিত্রায়নের মাধ্যমে নাটকটি সমাজের রীতিনীতি ও পুরুষ কর্তৃত্বের প্রশ্ন তুলে ধরে। 'মুখরা রমনী বশীকরণ' কেবল একটি বিনোদনমূলক নাটক নয়। এটি সমাজের গভীর স্তরে লুকিয়ে থাকা নারী-পুরুষ সম্পর্ক, ক্ষমতার লড়াই, এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের প্রশ্নগুলি তুলে ধরে। ক্যাথেরিনার চরিত্র আমাদের ভাবতে বাধ্য করে যে, 'ভালো' ও 'বদ' ধারণা কি সত্যিই স্থির, নাকি সময় ও পরিস্থিতির সাথে সাথে তা পরিবর্তনশীল।
চোখের বালি উপন্যাস অবলম্বনে |
কালিদাসের 'মেঘদূত' কাব্যের |
No comments