Header ads

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'চোখের বালি' উপন্যাসের মহেন্দ্র চরিত্র আলোচনা করো ।। Mahendra: Combination of Complexity and Diversity

মহেন্দ্র চরিত্র: জটিলতা ও বৈচিত্র্যের সংমিশ্রণ

    রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'চোখের বালি' উপন্যাস কেবল একটি প্রেমকাহিনী নয়, বরং এক জটিল মানবচরিত্রের সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ। এই উপন্যাসের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে মহেন্দ্র, যার ব্যক্তিত্বের বিভিন্ন দিক পাঠককে চিন্তাভাবনায় ডুবিয়ে দেয়। মহেন্দ্র উপন্যাসের সক্রিয়  ও প্রধান কেন্দ্রীয় চরিত্র- একজন শিক্ষিত, সুন্দর ও বুদ্ধিমান যুবক। সে তার আবেগ, চিন্তাভাবনা এবং সিদ্ধান্তের মাধ্যমে উপন্যাসের গল্পকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। তার চরিত্রের নানা জটিলতা ও বিক্ষেপ এ উপন্যাসের অন্যান্য চরিত্রকে প্রভাবিত করেছে। 

    'চোখের বালি' উপন্যাসে চরিত্র সৃষ্টির দিক দিয়ে মহেন্দ্রই সর্বাপেক্ষা জীবন্ত ও পূর্ণাঙ্গভাবে চিত্রিত হয়েছে। মহেন্দ্র চরিত্রটি জটিলতা ও বৈচিত্র্যের এক অসাধারণ মিশ্রণ। একদিকে, সে একজন উদারমনা, সহানুভূতিশীল এবং সত্যবাদী ব্যক্তি। অন্যদিকে, সে অস্থির, দ্বিধাগ্রস্ত এবং আত্ম-কেন্দ্রিক।

    আত্মপরায়ণতা মহেন্দ্র চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। শিশুকাল থেকে সে শুধু নিজেকে চিনেছে। সে যা চায় তাই সে করতে পারে, তার ইচ্ছাপূরণের পথে অন্য কেউই বাধা সৃষ্টি করতে পারে না। তার চরিত্রের সমস্ত পরিবর্তন এক আতিশয্য ও জনসংযমের ঐক্য-বন্ধনে গাঁথা। তার অপরিমিত মাতৃভক্তিপত্মীপ্রেম বিনোদিনীর সাথে নির্লজ্জ আতিশয্যেরই পূর্বসূচনা। 

    তার পত্মীপ্রেম ও পর নারী আসক্তি উভয়ের মূলে আছে এক প্রবল আত্মভিমান। সাধারণের থেকে সে যে পৃথক, এ বিষয়ে সে বিশেষ সচেতন- হৃদয়ের সম্পর্ক সম্বন্ধে মহেন্দ্রের উচত- অনুচিতের আদর্শ সাধারণের অপেক্ষা কিছু কড়া। 

    মহেন্দ্র চরিত্রটি রবীন্দ্রনাথের জটিল চরিত্র। মানসিক দুর্বলতা, অসংযম, স্বার্থপরতা, অধৈর্য ও অধিকারবোধ প্রভৃতি প্রবণতা নিয়ে মহেন্দ্র বিশিষ্ট অথচ সাধারণ। রবীন্দ্রনাথ তাকে বিবেচনা করেছেন চলমান সমগ্রজীবনের প্রেক্ষাপটে। মহেন্দ্র চরিত্রের মধ্যদিয়ে মধ্যবিত্ত শ্রেণির অধিকারবোধের প্রকাশ ঘটেছে। সে জীবনে যখন যা কামনা করেছে তাই সে অধিকার করেছে। 

    মহেন্দ্র তার আবেগের দ্বারা সহজেই প্রভাবিত হয়। বিনোদিনীর প্রতি তার আকর্ষণ, আশালতার প্রতি তার দায়িত্ববোধ এবং বিহারীর সাথে তার বন্ধুত্ব - এই সবকিছুই তার আবেগ দ্বারা পরিচালিত। তবে বিনোদিনীর প্রতি তার আবেগ বেশি লক্ষ্য করা গেছে। যেমন- "ভাবিয়া রাত্রে ঘুম হয় না।... ... আজকাল বিনোদিনীর ধ্যানে আমার আর-সকল ধ্যানই ভঙ্গ হইয়াছে।" বিনোদিনীর জন্য উদ্দাম প্রণয়াবেগ, আশার প্রতি কর্তব্যবোধ এবং বিহারীর প্রতি ঈর্ষা এ পরস্পরবিরোধী অথচ পরস্পর সংশ্লিষ্ট প্রবৃত্তির সমবায়ে মহেন্দ্র চরিত্র গড়ে উঠেছে। 

    মহেন্দ্রের কিছু স্বার্থপর আকাঙ্ক্ষাও লক্ষ্য করা যায়। বিনোদিনীর প্রতি তার আকর্ষণের কারণ ছিল তার সৌন্দর্য ও আকর্ষণ, তার চরিত্রের গভীরতা নয়। আশালতাকে সে বিয়ে করে কারণ সে তার ইচ্ছা পূরণ করতে চায়, ভালোবাসার জন্য নয়। মূলত প্রেমিক পুরুষের মধ্যে যে গভীরতা, পৌরুষ, নিষ্ঠা, দৃঢ়তা থাকা দরকার মহেন্দ্র চরিত্রে তা অনুপস্থিত। তবু সামগ্রিক দিক বিবেচনা করে দেখা যায়- মহেন্দ্রই ও উপন্যাসের নায়ক। 

    মহেন্দ্র চরিত্র সৃষ্টিতে রবীন্দ্রনাথের শিল্পদৃষ্টির সমগ্রতাবোধের প্রমাণ পাওয়া যায়। উপন্যাসের শেষে, আমরা দেখতে পাই যে মহেন্দ্র একটি পরিবর্তিত ও বিকশিত চরিত্রে পরিণত হয়েছে। মহেন্দ্র চরিত্রের একটি বিশেষ লক্ষ্যনীয় দিক হল- সে উচ্ছৃঙ্খল হলেও অমানুষ নয়। তার ত্রুটি ও দুর্বলতা তাকে আরও বাস্তব ও বিশ্বাসযোগ্য করে তোলে। অনুরাগ, বিরাগ, আকর্ষণ-বিকর্ষণ, প্রবৃত্তি-নিবৃত্তি ও আনন্দ-নিরানন্দ প্রভৃতির অনুভূতির যোগফলে মহেন্দ্র সত্য ।  


No comments

Theme images by Maliketh. Powered by Blogger.