পথের পাঁচালী উপন্যাসে জীবন ও সমাজ বাস্তবতার চিত্র ।। Pather Panchali: The Reality of Life and Society
পথের পাঁচালী উপন্যাসে জীবন ও সমাজ বাস্তবতার চিত্র
বাংলা কথাসাহিত্যের এক উজ্জ্বলতম নক্ষত্র বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৪-১৯৫০)। কী গল্পে, কী উপন্যাসে- আসলে সর্বত্রই তাঁর দৃষ্টি জীবনের পথে - প্রতি অসীম মমতায় পথ চলা এক পথিকের দৃষ্টি। এই বিচিত্র পথিকের জীবনের বিচিত্রের অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধির অজস্র ছবি ফুটে উঠেছে তাঁর উপন্যাসে। জীবন চলার পথের বিচিত্র অভিজ্ঞতার সমাহার হিসেবে 'পথের পাঁচালী'(১৯২৯) অনন্য সাধারণ। আসলে 'পথের পাঁচালী' উপন্যাস নয়- এ যেন নিপুন হাতে আঁকা ভারতীয় জীবন ও সমাজ বাস্তবতার চিত্র।
'পথের পাঁচালী' উপন্যাসে বিভূতিভূষণ সমাজ বাস্তবতার কথা বলতে গিয়ে টেনে এনেছেন রাজা বল্লাল সেনের কৌলীন্য প্রথার কাহিনী। সেই প্রথা অনুসারে নামজাদা নৈকষ্য কুলীনেরা এক একজন বহু কন্যার পাণিগ্রহন করতে পারতেন। এসব কুলীন জামাই পালা করে এক এক শ্বশুরবাড়ি আসতেন এবং মোটা পাওনা গণ্ডা আদায় করে পরের দিনই অন্য শ্বশুরবাড়ি রওয়ানা হতেন। স্ত্রীরা সকলেই যে যার বাপের বাড়িতেই অবস্থান করতো। পিতামাতার মৃত্যুর পর এদের দুর্দশার আর অন্ত ছিল না। ভাইয়ের অথবা অন্যান্য আত্মীয়ের গলগ্রহ স্বরূপ এরা দু'মুঠো অন্নের জন্য সংসারে 'বালাই' হয়ে পড়ে থাকতো। ইন্দির ঠাকরুন এমন কোনো মহাকুলীনের অন্যতম বলি। তিনিই 'পথের পাঁচালী'র বল্লালী বালাই। ঔপন্যাসিকের ভাষায়:
"শাঁখারীপুকুরে নালফুলের বংশের পর বংশ কত আসিয়াছে, চলিয়া গিয়াছে। চক্রবর্তীদের ফাঁকা মাঠে সীতানাথ মুখুয্যে নতুন করমের বাগান বসাইল এবং সে সব আবার বুড়া হইতেও চলিল। কত ভিটায় নতুন গৃহস্থ বসিল, কত জনশূন্য হইয়া গেল, কত গোলক চক্রবর্তী কত ব্রজ চক্রবর্তী কত জনসন টমসন সাহেব, কত মজুমদারকে কোথায় বাসাইয়া লইয়া গেল! শুধু পঁচাত্তর বছরের ইন্দির ঠাকরুন এখনো বাচিঁয়া আছেন।"
আম খেয়ে তার আটিঁ মাটিতে ফেলে রাখলে তা থেকে সবুজ গাছ গজায়। আটিঁর শক্ত খোলস ফেললে সবুজ অংস বেরিয়ে পড়ে। এই সবুজ অংশটাকে দিয়ে ছেলেমেয়েরা বাঁশি তৈরি করে। শহরের শিশুরা এ বাঁশি কোনোদিন বাজায়নি, বোধহয় চোখেও দেখেনি; কিন্তু পাড়াগাঁয়ের দরিদ্র সংসারের বালকবালিকারা এখনো এ বাঁশি তৈরি করে এবং বাজিয়ে আনন্দ লাভ করে। এ 'আমের আঁটি' থামে ঘষে বানানো বাঁশিকেই বিভুতিভূষণ 'আম-আঁটির-ভেঁপু' আখ্যা দিয়েছেন এবং পল্লিবালকের সরল আনন্দের প্রতীক রূপে ব্যবহার করেছেন। অপু দুর্গা পৃকৃতির কোলে বড়ো হয়ে উঠার বর্ণনায় ঋদ্ধ। সমস্ত প্রকৃতির পটভূমির মধ্যে দুটি সরল বালকবালিকা ধীরে ধীরে মুকুলিত হচ্ছে। তার চরিত্র অসাধারণত্ব আছে বটে কিন্তু সে ভারত-বাংলার পল্লি শিশু। তারা বৃষ্টিতে ভিজছে, নদীতে মাছ ধরছে, বনভোজন করছে, আম কুড়াচ্ছে, ভেট ফুলের গন্ধে আবিষ্ট আনন্দবিহ্বল কল্পনার দালপালা মেলে ধরছে। যেমন-
"সোনাডাঙ্গার মাঠ এ অঞ্চলের সকলের বড়মাঠ। এখানে ওখানে বনঝোঁপ, শিমুল-বাবলা গাছ, খেজুর গাছে খেজুর কাদিঁ ঝুলিতেছে, সোঁদালী ফুলের ঝাড় দুলিতেছে, চারিধারে বৌ কথা কও পাপিয়ার ডাক। দূরপ্রসারী মাঠের উপর তিমির ফুলের রঙের মত গাঢ় নীল আকাশ উপুড় হইয়া পড়িয়াছে, দৃষ্টি কোথা্ও বাধে না, ঘন সবুজ ঘাষে মোড়া উঁচু নিচু মাঠের মধ্যে কোথাও আবাদ নাই, শুধুই গাছপালা বনঝোপেঁর প্রাচুর্য আর বিশাল মাঠটার শ্যাম প্রসার, সম্মুখে কাঁচা মাটির চওড়া পথটা গৃহত্যাগী উদাস বাউলের মত দূর হইতে দূরে আপন মনে আঁকিয়া বাকিঁয়া চলিয়াছে।"
নিশ্চিন্দিপুর হতে অপুকে কাশীতে আনা হলো। নিশ্চিন্দিপুরের মুক্ত মাঠ, আনন্দের উপকরণ ছেড়ে কাশীতে মায়ের কাছে চরম দুঃখকষ্টের মধ্যে মানুষ হচ্ছে অপু। নিশ্চিন্দিপুরের জীবনলীলার মধ্যে লেখক কৃষ্ণের বৃন্দাবন লীলাকে প্রত্যক্ষ করেছেন। সোনাডাঙ্গার মাঠ, বেত্রবতী নদী, আশশ্যাওড়া বৃন্দাবনের সাথে তুলনা করেছেন। শৈশবের স্বপ্ন জগৎ ছেড়ে অপুকে যেতে হয় ব্যবহারিক জীবনের কঠিন নিষ্ঠূর মথুরায়।
'পখের পাঁচালী'তেই আমরা শিশু অপুকে পাই। তার চরিত্রে অসাধারণত্ব আছে বটে, কিন্তু সে বাংলার পল্লি শিশুও। অপুর সাধারণত্বের প্রমাণ পাওয়া যায় তার চালভাজা বা পানসে পায়েস খাওয়ার আনন্দে, তাজবিবির ছবি দেখার আনন্দে, বাবার অনুপস্থিতিতে লেখাপড়া ফেলে গুলি খেলতে বেরিয়ে পড়ায়, সামান্য খাদ্যবস্তু বা বুনো ফলমূলের আতিশয্যে দেখলেই মনে হয় একে তো আমরা চিনি, পাড়াগায়েঁর পথে ঘাটে বহুবার আমরা তাকে দেখেছি। অপু চরিত্রটি অনুসন্ধিৎসু, তার জানার আকাঙ্ক্ষাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছে দিদি দুর্গা। নিশ্চিন্দিপুর গ্রামের পথঘাট, বাঁশঝাড়, অরণ্য, আমের বাগান, পুকুরঘাট, সোনাডাঙার মাঠ সবকিছুই অপুকে আকর্ষণ করেছে। তার বাবার সাথে নীলকণ্ঠ পাখি দেখতে যাওয়া, দিদির সাথে রেলের রাস্তা দেখতে যাওয়া অপু চরিত্রে জানার স্পৃহাকে প্রকাশ করে। তার বাবার সাথে কুঠির মাঠ দেখতে গিয়ে সবকিছুই কৌতুহল ভরা দৃষ্টিতে অবলোকন করেছে। যেমন-
"বালক অবাক হইয়া চারিদিকে চাহিয় চাহিয়া দেখিতেছিল। তাহার ছয় সাত বছর জীবনে এই প্রথম বাড়ি হইতে এতদূর আসিয়াছে। এতদিন নেড়াদের বাড়ি.... রানু দিদের বাড়ি, ইহাই ছিল তার জগতের সীমা। ... ওই মাঠের পথ ওদিকে বুঝি রূপকথার রাজ্য?"
এ উপন্যাসে সর্বজয়া হরিহরের স্ত্রী, দুর্গা-অপুর জননী, দরিদ্র সংসারের বধূ। সর্বজয়া মহীয়সী মহিলা নয়, তার অনেক দোষত্রুটি আছে। সে মুখরা, স্বর্থপর, সংকীর্ণচিত্ত সর্বপ্রকার শিক্ষাদীক্ষাহীন। অনেক ত্রুটিবিচ্যুতি থাকা সত্ত্বেও বিভূতিভূষণ তার মাতৃমহিমাকে ক্ষুণ্ণ করে দেখেননি। সর্বজয়া যে আমাদের মনে এতখানি নাড়া দেয় তার একমাত্র কারণ মাতৃত্বের মহিমা; অপুর প্রতি তার ভালোবাসার গভীরতা ও তীব্রতা।
হরিহর সাধারণ অবস্থার পৈতিক আমলের সামান্য জমিজমার আয় ও দু'চার ঘর শিষ্য সেবকের প্রণামীতে সাদাসিধেভাবে তার সংসার চলে। অভাবের কারণে মাঝে মাঝে সংসারত্যাগী হয় কিন্তু অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয় না। অর্থকষ্ট লেগেই থাকে। হরিহরে একটা শিল্পী মন ছিল তার কথকবৃত্তি, গ্রন্থ সংগ্রহের প্রবণতা সে দিকেই ইঙ্গিত করে। অপু নিজের প্রকৃতিপ্রীতি ও রোম্যান্স পিপাসার মূল সে খুজেঁ পেয়েছে পিতৃচরিত্রের উত্তরাধিকারের মধ্যে, এখানেই হরিহর চরিত্রের সর্বৈব সাফল্য।
পথের পাঁচালী উপন্যাসে একাধিক মৃত্যুর কথা উল্লেখ আছে। কিন্তু সেগুলো এ উপন্যাসের জন্য কোনো সমস্যা হিসেবে দেখা দেয়নি। হয়তো তার মধ্যে করুণ-গোপন-অশ্রুপাত ঘটেছে কিন্তু সেগুলো বাস্তবে কোনো প্রভাবা ফেলেনি; বরং মনে হয়েছে জীবন চলার পথে এমন মরণ স্বাভাবিক।
উপযুক্ত আলোচনা থেকে বলা যায় যে, 'পথের পাঁচালী'র মধ্যে সমাজ ও বাস্তব জীবনের গতি চেতনাই মুখ্য সুর। জন্ম থেকে শুরু করে জীবনের পথ বেয়ে মৃত্যুর মধ্য দিয়ে জন্ম-জন্মান্তরের বিচিত্র পথ অতিক্রম করে মনবতার অভিযাত্রী রূপ ক্রমবিবর্তিত হয়ে চলেছে। 'পথের পাঁচালী'তে সেই নিত্য চলমান জীবন বন্দনার গান বেজে উঠেছে।
পথের পাঁচালী উপন্যাস অবলম্বনে |
No comments