মেঘদূত কাব্যের যৌনতার বিষয়গত সার্থকতা আলোচনা কর ।। Sexuality in 'Meghdoot' poetry
কালিদাস 'মেঘদূত' কাব্যে ইন্দিয়ানুভূতিকে কাব্যসৌন্দর্যে রূপায়িত করেছেন।
ভারতীয় ক্লাসিক সাহিত্যের পূর্ণপ্রতিভূ কালিদাস ছিলেন রাজসভার কবি।
স্বভাবত ঐশ্বর্য বিলাসে তিনি লালিত, সেজন্যে তাঁর কাব্যসমূহে ভোগ-বাসনা, বিলাস-ব্যসনের আধিক্য ঘটেছে। তবে কবিত্বশক্তিরগুণে এ ভোগস্পৃহাকেই তিনি সৌন্দর্যমণ্ডিত করে তুলেছেন এবং ইন্দ্রিয় চেতনাকে কাব্যসৌন্দর্যে রূপায়িত করেছেন।
কালিদাস সৌন্দর্য সাধক। তাঁর সৌন্দর্যবেোধের মূলে রয়েছে জীবনের এক গভীরতর উপলব্ধি। কবি লক্ষ্য করেছেন মানুষের জীবনের পরম কল্যাণ ও শান্তি নিহিত আছে মানুষের কামনা, বাসনা ও ইন্দ্রিয়জ তৃপ্তির মাঝে। তাই মেঘদূত কাব্যে ইন্দ্রিয়ানুভূতির প্রাধান্য ঘটেছে। এ কাব্যে কালিদাস যেসব উপমা, রূপক, উৎপ্রেক্ষা ও চিত্রকল্পের অবতারণা করেছেন তা মূলত ইন্দ্রিয়জ। কাব্যের আদ্যন্ত নারী ও নারীদেহ থেকে উপমা আহরিত হয়েছে। নদীকে কবি নারী রূপে দেখেছেন। পর্বতসমূহ নারীর স্তনের প্রতিরূপ, নদীতট নারীর নিতম্ব, নদী-গিরি মেঘের প্রণয়িনী। পর্বত শিখরের সাথে তিনি পয়োধরের উপমা দিয়েছেন এবং নগরীকে পর্বতের প্রণয়িনীরূপে কল্পনা করেছেন। 'পূর্বমেঘে'র ভূগোল ও 'উত্তর মেঘে'র অলকা সর্বত্র ইন্দ্রিয়জ আবেদন প্রাধান্য লাভ করেছে। কতিপয় দৃষ্টান্ত:
১, দেখবে যেতে-যেতে স্খলিত, মনোরম ভঙ্গি নেয় নির্বিন্ধ্যা,
ঢেউয়ের সংঘাতে মুখর বিহগেরা রচনা করে তার কাঞ্চীদাম,
ঘূর্ণি নাভি তার দেখায়, তুমি তাই সরস হবে তার সন্নিপাতে,
জানো তো হাবেভাবে আদ্য অনুরাগ জানায় দয়িতেরে প্রমদা। (পৃ:২৯)
২. প্রান্ত ছেয়ে আছে আম্রবনরাজি, ঝলক দেয় তাতে পক্ব ফল,
বর্ণে চিক্কণ বেণীর মতেো তুমি আরূঢ হ'লে সেই শৃঙ্গে-
দৃশ্য হবে যেন ধরার স্তনতট, অমরমিথুনের ভোগ্য,
গর্ভসূচনায় মধ্যে কালো আর প্রান্তে পাণ্ডুর ছড়ানো। (পৃ:১৮)
৩. তটের কলতানে রূপসী রমণীর ভুরুর ভঙ্গিমা যে দেয় একেঁ,
ঊর্মি-চঞ্চল বেত্রবতী সে-ই করবে পান তার মধুর বারি। (পৃ:২৫)
৪. আকুল প্রণয়ীরা আবেগভরে যেথা উচ্ছসিত হাতে সহসা
নীবির বন্ধন খসিয়ে, ক'রে দেয় ক্ষৌম অংশুক স্রন্ত, (পৃ: ৭৫)
এগুলো মূলত যৌনজ। আর তাই অনুবাদক ও সমালোচক বুদ্ধদেব বসু 'মেঘদূত'র বিরুদ্ধে যৌনতার অভিযোগ এনে বলেছেন,
"মেঘদূত'র যক্ষ একজন লিবিডোভারাতুর জীব, তার প্রেমের ধারণা শৃঙ্গার বাসনায় সীমাবদ্ধ। .... কালিদাস যক্ষের মুখে যা কিছু বসিয়েছেন তার প্রায় প্রত্যেকটি তার রুদ্ধ রতির ব্যঞ্জনা দিচ্ছে। ... 'মেঘদুত'র অন্য যেসব পশুপক্ষী দেখা যায় তাদের প্রায় সকলেরই মৈথুন ঋতু বর্ষা, কাকাদির নীড় নির্মাণ ও হস্তীর মদস্রাবেও যক্ষের কামনা প্রকাশ পাচ্ছে। যেমন পর্বতে বিশ্রাম, তেমনি মেঘ পথে পথে নদীসমূহে অবতারণা করবে; তার এ কর্মে খুবই স্পষ্টভাবে রতিক্রিয়ার ছবি আঁকা হল একবার নয়, বার বার, মেঘ নায়করূপে এ ভিন্ন প্রকৃতি নদী নায়িকাদের তৃপ্তি সাধন করে নিজেও পরিতৃপ্ত হচ্ছে। ... 'মেঘদূত' কাব্যটি যৌনধর্মের প্রভাবে একবারে পূর্ণ ও পরিস্ফীত। কী পূর্বমেঘে, কী উত্তরমেঘে, নারী ও রতিপ্রসঙ্গের উল্লেখ বহুল পরিমাণে অত্যধিক।"
বুদ্ধদেব বসুর এ যুক্তি ও অভিমত মেনে নিয়ে আমরাও বলতে পারি যে, 'মেঘদূতে' এমন শ্লোকের সংখ্যা অল্পই, যাদের বিষয় সম্পূর্ণরূপে অযৌন। এ কাব্যে ইন্দ্রিয়ানুভূতির প্রাধান্য ঘটেছে। তবে আমাদের এ কথাও মনে রাখতে হবে যে, সংস্কৃত সাহিত্যে আদিরস বা শৃঙ্গার রস জীবনের একটি স্বাভাবিক অঙ্গরূপে গৃহীত ও স্বীকৃত হয়ে থাকে। এখানে বাংলা সাহিত্যের সাথে সংস্কৃত সাহিত্যের মূলগত ব্যবধান। বাংলা সাহিত্যের প্রায় লেখকের মধ্যে একটি পিউরিটানসুলভ মনোভাব স্বকীয়। তথাকথিত ভদ্র, তথ্য-নীতিবোধ ও শালীনতাবোধ দ্বারা তাঁরা আচ্ছন্ন। কিন্তু আর্য সভ্যতায় রতিশাস্ত্র একটি শাস্ত্রমতরূপে গৃহীত। সংস্কৃত কবিরা নীতিবোধ ও শালীনতাবোধ দ্বারা সংকুচিত ছিলেন না। এজন্য কালিদাসের কাব্য 'মেঘদূতে' আমরা ইন্দ্রিয়জ প্রেমের ছবি দেখতে পাই। কারণ তিনি ছিলেন শৃঙ্গার রসের কবি এবং তাঁর কাছে ইন্দ্রিয়জ আবেদন জীবনেরই অংশ। এ প্রসঙ্গে সমালোচক হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর অভিমত, 'মেঘদূত' কাব্যের সৌন্দর্য অনুধাবন করতে হলে তথাকথিত শালীনতাবোধের ঊর্ধ্বে উঠতে হবে। তিনি বলেছেন,
"রুচি, দেশ কাল পাত্র অনুসারে বদলায়, সৌন্দর্য বদলায় না। এখন যাহা কুরুচি, কালিদাসের সময়ে তাহা কুরুচি ছিল না।" (বঙ্গদর্শন পত্রিকা)
কালিদাস ছিলেন প্রেম ও সৌন্দর্যের কবি। তাই 'মেঘদূত' কাব্যে তিনি ভোগস্পৃহাকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করে তুলেছেন। কালিদাসের কবিত্বগুণে কাব্যটি যৌন আবেদন সত্ত্বেও পাঠকের কাছে ক্লন্তিকর হয়ে উঠে নি। যক্ষ কামুক, 'তার বিরুদ্ধে আমাদের অভিযোগ অনেক, যে তার প্রিয়াকে 'একপত্নী' বা মাধবী বলে ঘোষণা করলেও নিজেকে মুখ ফুটে কখনো অনন্যমুখী বলছে না'। যক্ষের কাছে নিজের বেদনার চেয়ে পত্নীর বেদনাই বড়। সে নিজের দুঃখের চেয়ে স্ত্রীর দুঃখকে বড় করে দেখেছে,
'কেমনে প্রিয়তমা রাখবে প্রাণ তার অদূরে উদ্যত শ্রাবণে
যদি- না জলধরে বাহন ক'রে আমি পাঠাই মঙ্গল-বার্তা? (পৃ:৪)
অর্থ্যাৎ সে নিজেকে নিয়ে কাতর নয়, কাতর প্রিয়তমাকে নিয়ে। পত্নী কেমন আছে তা জানার জন্য সে ব্যাকুল। তার সকল প্রতীক্ষা, উৎকন্ঠা সেই নিত্য সৌন্দর্য থেকে প্রতীক্ষারতা এক বিরহী নারীর জন্য । সে বলে,
" অধুনা ধাতুরাগে শিলায় আঁকি আমি প্রণয়কোপবতী- তোমাকে,
সে-পটে আপনাকে লোটাতে চাই যদি তোমার চরণের প্রান্তে, ...
স্বপ্নে কোনমতে তোমায় কাছে পেয়ে নিবিড় আশ্লেষে ব্যগ্র
আমার প্রসারিত বাহুর বিক্ষেপ ব্যর্থ হয় যবে শূন্যে, ...
তোমার সুকুমার অঙ্গ বুঝি বা সে পরশ করেছিল পূর্বে -
আমি সে- তনুহীন সুরভি বাতাসেরে আলিঙ্গনে বাধিঁ অতএব।"
এখানে যক্ষের বিরহের অভিব্যক্তিতে 'শুধু অলংকার ও রতিশাস্ত্রের নিয়মরক্ষা করা হয় নি, একটি অভিজ্ঞতা প্রকাশ পেয়েছে'। হতে পারে সে অভিজ্ঞতা তার ইন্দ্রিয় দমনের ক্লেশ কিন্তু কালিদাসের রচনায় শ্রেষ্ঠত্ব এখানেই যে তিনি তাকেই দুঃখের মর্যাদা দিতে পেরেছেন এবং তাতে 'অর্পণ করেছেন একটি স্নিগ্ধগম্ভীর সৌন্দর্য ও কারুণ্যের উদ্ভাস' । যক্ষ কামুক হলেও তার ইন্দ্রিয়ানুভূতি নিছক লালসার স্তরে পর্যবসিত হয় নি; তার বেদনা আমাদের মনকে ছুঁয়ে যায়। ও কাব্যে যৌনতা একটি বিষয়গত সার্থকতা লাভ করেছে এবং কাব্যের কাহিনির সাথে তা সম্পৃক্ত। 'মেঘদূত' কাব্যের মূল আবেদন লক্ষ্য করলে বলা যায়, এ কাব্যে দৈহিক সম্ভোগ লালসার উপর আন্তরিক প্রণয় প্রাধান্য লাভ করেছে। উত্তর মেঘের শেষাংশে এসে যক্ষের বেদনা আমাদের প্রগলভ বলে মনে হয় না। যক্ষ তার পত্নীর কথা ভেবে ব্যাকুল হচ্ছে। এক বছরের দারুণ বিরহে সে কোমল কুুসুম 'বৃন্তচ্যুত' হয়েছে। তাই সে পত্নীর কুশল জানার জন্য ব্যাকুল হয়েছে। যক্ষ মেঘের মুখ দিয়ে বলছে,
"তোমার সহচর, যদিও বিরহিত, জীবিত আছে রামগিরিতে।
অবলা, তোমাকে সে কুশল জিজ্ঞাসে; প্রথমকৃত্য এ - প্রশ্ন,
কেননা প্রাণীদের জীবন অস্থির, বিপদ ঘটে অতি সহজে।" (পৃ:১০৪)
তুমি কেমন আছ? কিংবা ভালো আছ তো? একথার মর্ম কত গভীর তা প্রণয়ী মাত্রই জানে। 'মেঘদূত' যক্ষের ও গাঢ় কণ্ঠস্বরকে আমরা অবিশ্বাস করতে পারি না। তার বেদনা, তার বিরহকে আমরা উপলব্ধি করতে পারি। যদিও যক্ষের প্রেমের ধারণা শৃঙ্গার কামনায় সীমাবদ্ধ তবু এই প্রথম আমাদের প্রতীতি জন্মে যে যক্ষ সত্যি সত্যি কষ্ট পাচ্ছে। পত্নীর জন্য যক্ষের বিরহ বেদনা নিছক লালসা নয়, সুগভীর আন্তরিক প্রণয়রই চিহ্ন। যক্ষের কান এখানে পরিশীলিত রূপ পরিগ্রহ করেছে। সমালোচকের ভাষায়,
"তার (যক্ষের) কাম এখন পরিশীলিত, বহুমুখী ও দ্যুতিময় যে শুধু তাই অবলম্বন করে একটি মহৎ কাব্যের সৃষ্টি হতে পারলো। ... কাম এখানে রোমাণ্টিক বেদনায় রূপান্তরিত না হলেও বিশ্বের পটভূমিকায় বিন্যস্ত হয়েছে, যক্ষের মানস রমণে অংশ নিচ্ছে রামগিরি থেকে অলকা পর্যন্ত সমস্ত জড় ও জীবজগৎ। কামের এ বিশ্বরূপ পৃথিবীর অন্য কোন কাব্য আমাদের দেখাতে পারে নি। ... তার (যক্ষের) বার্তা, তার আশ্বাসবাক্য, তার হৃদয়গ্রাহী অভিজ্ঞান সবই আমাদের বাধ্য করে তার কামনার প্রতি সশ্রদ্ধ হতে। "
সমালোচক হরপ্রসাদ শাস্ত্রীও 'মেঘদূত' কাব্যের সৌন্দর্য বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বাঙালির রক্ষণশীল মনোভাবকে উপেক্ষা করেছেন। তাঁর মতে, "এ কাব্যের সৌন্দর্য অনুধ্যান করতে হলে তথাকথিত শালীনতা বোধের উর্ধ্বে উঠেতে হবে।" বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও 'মেঘদূত' কাব্যের সৌন্দর্য আবিষ্কার করেছেন। তিনি চির সৌন্দর্যের লীলা নিকেতন 'অলকাপুরী'তে কল্পনার মেঘদূত পাঠাতে চেয়েছেন। এ সূত্রে তাঁর মন্তব্য,
"পূর্বমেঘে বহু বিচিত্রের সাথে সৌন্দর্যের পরিচয় এবং উত্তরমেঘে সে একের সাথে অনন্তের সম্মিলন। .... পূর্বমেঘ পৃথিবীর বিচিত্র সৌন্দর্য পর্যটন করে উত্তর মেঘে অলকাপুরীর নিত্য সৌন্দর্যে উত্তীর্ণ হতে হয়।" (মেঘদূত প্রবন্ধ)
সুতারাং, আমরা বলতে পারি, 'মেঘদূত' কাব্যে ইন্দ্রিয়ানুভূতির প্রাধান্য ঘটলেও কবি তাঁর প্রতিভার স্পর্শে কাব্য সৌন্দর্য সৃষ্টিতে সক্ষম হয়েছেন। এতে ইন্দ্রিয়চেতনা নিছক লালসার স্তরে পর্যবসিত হয় নি, তা এক গভীল সৌন্দর্যবোধ দ্বারা আচ্ছন্ন।
No comments