বাংলা উপভাষা চর্চার ইতিহাস ।। History of Bengali dialect practice
বাংলা উপভাষা চর্চার ইতিহাস
বাংলা উপভাষা চর্চা শুরু হয়েছে বিদেশিদের দ্বারা। পর্তুগিজ পাদ্রী মনোয়েল দ্যা আসসুম্পসাও ১৭৩৪ খ্রিস্টাব্দে গাজীপুরের ভাওয়ালে বসে বাংলা ভাষার প্রথম উপভাষা গ্রন্থ রচনা করেন। ১৭৪৩ খ্রিস্টাব্দে গ্রন্থটি পর্তুগালের রাজধানী লিসবন থেকে প্রকাশিত হয়। এ গ্রন্থে বাংলা থেকে পর্তুগিজ এবং পর্তুগিজ থেকে বাংলার শব্দসমূহ সংকলিত হয়েছে। ধর্মীয় কারণে তিনি এসব সংগ্রহ করেছিলেন । গ্রন্থটি বাংলা উপভাষা চর্চার মাইল ফলক হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। এরপর বাংলা উপভাষা চর্চায় উনিশ শতকে কিছু গ্রন্থ ও প্রবন্ধের নাম পাওয়া যায়। ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত প্যারীচাঁদ মিত্রের "আলালের ঘরের দুলাল" উপন্যাসে বিদ্যাসাগরের গদ্যরীতির প্রতিবাদ হিসেবে উপভাষা চর্চা করেছেন। অর্থাৎ তিনি তাঁর লেখায় বাংলা আঞ্চলিক ভাষার শব্দ ব্যবহার করেছেন সচেতনভাবে। তাঁর এই আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহারের কারণে তিনি সাহিত্যের ভষায় আঞ্চলিক শব্দগুলো স্থান দিতে পেরেছেন। পরবর্তীকালে এই ধারাবাহিকতা লক্ষ্য করা যায়। এরপর কালীপ্রসন্ন সিংহ প্যারীচাঁদ মিত্রের পথ অনুসরণ করলেন। কালীপ্রসন্ন সিংহ তাঁর "হুতোম প্যাচাঁর নকশা"য় পর্যাপ্ত আঞ্চলিক শব্দ ব্যবহার করেছেন। প্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে। আঞ্চলিক ভাষার প্রতি আবেগ এবং শ্রদ্ধা থেকেই তারা উপভাষা চর্চায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন।
১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ শাসনামলে সরকারি উদ্যোগে ঢাকা, ফরিদপুর, ময়মনসিংহ, সিলেট ও কাছের জেলার ইতিহাস ও পরিসংখ্যান পৃথকভাবে প্রকাশিত হয়। এই মিলিত প্রতিবেদনে কিছু আঞ্চলিক শব্দ পাওয়া যায়। প্রতিবেদনটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। উপর্যুক্ত আলোচনায় বাংলা উপভাষা চর্চায় তেমন কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি সক্রিয় ছিল না। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ পত্রিকা বাংলা উপভাষা শব্দ সংগ্রহের ক্ষেত্রে প্রথম সচেতনভাবে কাজটি সম্পন্ন করে। বেশকিছু উপভাষা ও শ্রেণী উপভাষার শব্দ সংগ্রহ করে এ পত্রিকায় প্রকাশ করা হয়। কোন প্রকার প্রশিক্ষণলব্ধ প্রযুক্তি বা তাত্ত্বিক জ্ঞান ছাড়াই লেখকগণ নিজ নিজ অঞ্চলে শব্দ সংগ্রহ করার ফলে , শব্দগুলো সচেতনভাবে সংগৃহিত হয়েছিল। এসব লেখকদের মধ্যে সতীশ চন্দ্র ঘোষ, রাজেন্দ্র কুমার মজুমদার, রজনীকান্ত চক্রবর্তী, হরিনাথ ঘোষ, চন্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, নরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, মোল্লা রবিউদ্দীন আহমদ, চিন্তাহরণ চক্রবর্তী প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।
বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ বাংলা উপভাষা চর্চার ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য নাম। ১৩২৩ সালে এ পরিষদ থেকে প্রকাশিত হয় "হাজার বছরের পুরনো বাংলা ভাষার বৌদ্ধগান ও দোহা"। এটি হলো বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে প্রাচীনতম গ্রন্থ। বাংলা ভাষায় প্রাচীনতম সাহিত্যিক নিদর্শণ। এ গ্রন্থে বাংলা উপভাষা শব্দাবলী ব্যবহৃত হয়েছে। এরপর "র্পাজরিটারের ভোকাবুলারি অফ পিকিউলিয়ার ভার্নাকুলার ব্যাঙলী ওয়ার্ডস" নামে উপভাষা শব্দকোষ প্রকাশিত হয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে ভারতীয় উপমহাদেশে উপভাষা চর্চার অন্যতম প্রতিভূ হলেন জর্জ আব্রাহাম গ্রিয়ারসন। ১৯০৩-১৯২৭ সালের মধ্যে গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। প্রন্থটি প্রায় দুই যুগ ধরে খণ্ড খণ্ড আকারে প্রকাশিত হয়। এটি ১১ খণ্ডে এবং ১৯টি ভাগে প্রকাশিত হয়। এ গ্রন্থে ৫ম খণ্ডের প্রথম ভাগে স্থান পেয়েছে বাংলা ও আসামী ভাষা। এই খণ্ডটি বাংলা উপভাষা চর্চার অমূল্য গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত। গ্রন্থটি দ্বিভাষিক। বাংলা ও ইংরেজিতে এবং রোমান হরফে প্রতিবর্ণীকরণ করা হয়েছে। গিয়ারসনের পরে বাংলা উপভাষা চর্চায় গুরুত্বপূর্ণ নাম হচ্ছে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। তিনি প্রাচীন বাংলার ৪টি ভৌগোলিক বিভাজন অনুসারে উপভাষার নামকরণ করেছেন। এ নামগুলো বাংলা উপভাষার শ্রেণীকরণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। এ বিভাজনগুলো হলো: রাঢ় উপভাষা, বরেন্দ্র উপভাষা, কামরূপ উপভাষা, বঙ্গ উপভাষা। এ ৪টি শাখাকে আবার তিনি বিভিন্ন উপশাখায় ভাগ করেছেন। বঙ্গীয় উপভাষার শাখা হলো দুটি। (১) পাশ্চাত্য দক্ষিণ উপশাখা, (২) পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব উপশাখা।
এরপর উপভাষার শ্রেণীকরণে ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ অবদান রেখেছেন। তাঁর গবেষণার ভিত্তি মূলত গ্রিয়ারসন এবং সুনীতিকুমারের তথ্যের উপর নির্ভরশীল। তিনি বাংলা উপভাষাগুলোকে প্রধান দুটি শাখায় ভাগ করেছেন। প্রাচ্য শাখা এবং পাশ্চাত্য শাখা । এ দুটি শাখাকে তিনি আবার বিভিন্ন উপশাখায় শ্রেণীবিন্যাস করেছেন। তবে ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ'র বড় কৃতিত্ব হলো পূর্ব পাকিস্তানি আঞ্চলিক ভাষার অভিধান রচনা করা। ১৯৫৮ সালে তিনি এ অভিধানের কাজ শুরু করেন এবং ১৯৬৫-১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তা তিন খণ্ডে প্রকাশিত হয়। পরবর্তীকালে এটিকে বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান নামকরণ করা হয়। ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে গ্রন্থটি একখণ্ডে প্রকাশ করা হয়। বাংলাদেশের উপভাষা চর্চায় ও গবেষণায় গ্রন্থটির গুরুত্ব অপরিহার্য । বাংলা উপভাষা চর্চায় উপভাষার শ্রেণিকরণ ব্যতিরেকে ধ্বনিতাত্ত্বিক ও রূপতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে কেউ কেউ বাংলা উপভাষা চর্চায় আত্মনিয়োগ করেছেন। এদের মধ্যে কোনো কোনো গবেষকেরা বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান ও সাধারণ জ্ঞান ভিত্তিরূপে কাজ করেছেন। এর ফলে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট ও নোয়াখালী অঞ্চলের কিছু কিছু উপভাষার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আমরা অবগত হয়েছি। এ প্রসঙ্গে সন্দীপের উপভাষা নিয়ে পিএইচডি লাভ করেছেন রাজিব হুমায়ূন। তার এই পিএইচডি অভিসন্দর্ভ গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছে। এ গ্রন্থে তিনি সমাজ ভাষাজ্ঞিানের দৃষ্টিকোন থেকে সন্দ্বীপের উপভাষার ভাষাতাত্ত্বিক উপাদান বিশ্লেষণের প্রয়াস পেয়েছেন। গ্রন্থটি উপভাষা চর্চার ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এরপর পি. এম. শফিকুল ইসলাম রাজশাহী ভাষার উপর কাজ করেছেন। এ অভিসন্দর্ভটিও পুস্তক আকারে প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের উপভাষা নিয়ে ২০০৭ সালে এশিয়াটিক সোসাইট থেকে প্রকাশিত হয় বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক সমীক্ষামালা। এ গ্রন্থে দিনাজপুরের উপভাষা থেকে শুরু করে চট্টগ্রামের উপভাষা অর্থাৎ চট্টগ্রামের উপভাষাসহ বাংলাদেশের ১৭টি উপভাষা নিয়ে কাজ করা হয়েছে। এসব উপভাষার আলোচনায় ভাষাতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ প্রতিফলিত হয়েছে। বাংলা উপভাষার সাংগঠনিক বিশ্লেষণে এটি একটি 'মাস্টার পীস' হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। বাংলা উপভাষা অধ্যায়নে এশিয়াটিক সোসাইটির কাজটি সঙ্গত কারণেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ।
বাংলা উপভাষা চর্চায় যে অন্বেষণ বহুকাল থেকেই শুরু হয়েছে তা আজও অব্যাহত। ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রীক উপভাষা চর্চার দিগন্ত ভবিষ্যতে আরও উন্মোচিত হবে বলে আশা করা যায়।
No comments