মুদ্রাস্ফীতি বা মূল্যস্ফীতি এবং মুদ্রাস্ফীতির প্রকারভেদ ।। Inflation and Types of Inflation
মুদ্রাস্ফীতি বা মূল্যস্ফীতি:
মূলত সামগ্রিক যোগানের চেয়ে সামগ্রিক চাহিদা
বেশি হলে এবং ফি বছর দামস্তর বাড়তে থাকলে অর্থনীতিতে মুদ্রাস্ফীতি প্রবণতা দেখা দেয়।
তবে একটি বা কয়েকটি পণ্যের দাম হঠাৎ করে বাড়লেই তাকে মুদ্রাস্ফীতি বলা যাবে না, বরং
সার্বিকভাবে সব পন্য ও সেবার পড় দাম বা দামস্তর উত্তরাত্তর বৃদিধ পেতে থাকলেই কেবল
তাকে মুদ্রাস্ফীতি বলে আখ্যায়িত করা যায়। আবার দামস্তর এক অঙ্কের ঘরে উঠানাম করলেওদা
মুদ্রাস্ফীীত বলে অর্থনীতিবিদগণ সমস্যা হিসেবে বিবেচনায় নেন না। কারণ ১০% এর নিচে দামস্তরের
বৃদ্ধি অর্থনীতির বিকাশের জন্য সহায়ক বলে মনে করা হয়।
উল্লেখ্য, ইংরেজি ‘Inflation’ শব্দের বাংলা
প্রতিশব্দ হিসেরব প্রায়ই ‘দামস্ফীতি বা মূল্যস্ফীতি’ পদবাচ্যও ব্যবহৃত হয়ে থাকে। তবে
‘মুদ্রাস্ফীতি’ পদবাচ্যট্ বহুল ব্যবহৃত ও বহুল পরিচিত হয়ে আসছে। একানে আরও উপায়ে অর্থনীতিতে
মুদ্রাসরবরাহ বাড়লে পণ্য ও সেবার দাম বাড়ে। যেমন সরকার বা কেন্দ্রীয় ব্যাংক নতুন অতিরিক্ত
মুদ্রা ছাপিয়ে অর্থনীতিতে ছাড়তে পারে, ব্যাংকগুলো সহজ ঋণ সরবরাহ নীতি গ্রহণ করতে পারে,
সরকার ঘাটতি ব্যয় নীতি গ্রহণ করতে পারে, বৈদেশিক সাহায্য ও অনুদানের প্রবাহ বাড়তে পারে
ইত্যাদি কারণে অর্থনীতিতে মুদ্রার স্ফীতি ঘটতে পারে। এর ফলে পণ্য ও সেবার উৎপাদন সমানতালে
না বাড়লে দামস্তর বাড়ে এজন্য দাম বৃদ্ধির প্রবণতাকে মুদ্রাস্ফীতি বলে আখ্যায়িত করা
হয়। কিন্তু মুদ্র সরবরাহ ঠিক থাকলেও দামস্তর বাড়ে। পণ্য ও সেবার চাহিদা বৃদ্ধি, খরচ
বৃদ্ধি, জনসংখ্যাবৃদ্ধিসহ বিভিন্ন কারণে দাম বৃদ্ধি পেতে পারে। এ কারণে দাম বৃদ্ধির
প্রবণতাকে ‘দামস্ফীতি’ নামে অভিহিত করাই অধিক যুক্তিযুক্ত। কিন্তু ‘দামস্ফীতি’ ধারণাটির
প্রয়োগ নেই বললেই চলে। এর পরিবর্তে বরং ‘মুদ্রাস্ফীতি’ বা ‘মূল্যস্ফীতি’ ধারণাদ্বয়ই
সাধারণভাবে ব্যবহৃত হয়। আবার অর্থনীতির ছাত্রমাত্রই জানেন যে, ‘মূল্য’ বলতে কোনো পণ্যের
‘ব্যবহারিক মূল্য’কেই বুঝানো হয় ওবং ‘দাম’ বলতে তার ‘বিনিময় মূল্য’কে (টাকার অঙ্কে
প্রকাশিত পণ্যমূল্য) বুঝানো হয় । এখন দাম বাড়লে পণ্যের বিনিময় মূল্য বাড়ে বটে- ব্যবহারিক
মূল্য বাড়ে না। কাজেই দামবৃদ্ধির প্রবণতাকে ‘মূল্যস্ফীতি’ নামে অভিহিত করা সমীচীন নয়।
যাই হোক, দামবৃদ্ধির প্রবণতাকে সাধারণভাবে ‘মূল্যস্ফীতি’ কিংবা ‘মুদ্রাস্ফীতি’ উভয়
নামেই অভিহিত করা হয়ে থাকে।
মুদ্রাস্ফীতির
বৈশিষ্ট্য (Features of Inflation): অর্থনীতিতে মুদ্রাস্ফীতি পরিস্তিতি বিরাজ করছে
কিনা তা জানার জন্য কিছু লক্ষণ বা বৈশিষ্ট্য জান থাকা দরকার। মুদ্রাস্ফীতি বা মূল্যস্ফীতির
কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল-
১.
দামস্তর ক্রমাগত বাড়তে তাকে।
২.
অর্থের ক্রয়ক্ষমতা কমতে থাকে।
৩.
বিনিময়ের মাধ্যম এবং সঞ্চয়ের বাহন হেসেবে অর্থের গুরুত্ব হ্রাস পায়।
৪.
সামগ্রিক যোগানের চেয়ে সামগ্রিক চহিদা বেশি হয় বা যোগানের চেয়ে চাহিদা অধিক হারে বাড়তে
থাকে।
৫.
সহনীয় মুদ্রাস্ফীতির আওতায় মুনাফার প্রত্যাশা বাড়ে, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও উৎপাদন
বাড়তে থাকে।
৬.
সহনীয় মাত্রায় মুদ্রস্ফীতির আওতায় অর্থনীতিতে বেকারত্ব কমে ও প্রবৃদ্ধির হার বাড়ে।
৭.
উচ্চ হারের মুদ্রস্ফীতি অর্থনীতিতে অস্থিতিশীলতা আনয়ন করে, বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অবিশ্বাস
ও অনিশ্চয়তা দেখা দেয়, জনজীবনে যনত্রণা বাড়ে।
উল্লেখিত বৈশিষ্ট্যসমূহের আলোকে একটি দেশে মুদ্রাস্ফীতি পরিস্থিতি
বিরাজ করছে বলে মনে করা হয়।
মুদ্রাস্ফীতির
হার নির্ণয় (Calculation of Rate of Inflation): মুদ্রাস্ফীতি ধারণাটি শতকরা হারে প্রকাশ করা হয়।
অতীতের কোন ভিত্তি বছরের দুলনায় বর্তমান বছরের দামস্তরের শতাংশিক পরিবর্তনকে (বৃদ্ধিকে)
মুদ্রাস্ফীতির শতকরা হার বলে। মুদ্রাস্ফীতির শতকরা হার নির্ণয়ের জন্য নিম্নোক্ত সূত্র
প্রয়োগ করা যেতে পারে।
মুদ্রাস্ফীতির হার = (P1 - P0)/P0 ✖ 100
এখানে,
P1= বর্তমান বছরের দামস্তর
P0=
পূর্বের বছরের দামস্তর
ধরা যাক, কোন দেশের ২০২২ ও ২০২৩ সালে দামস্তর যথাক্রমে ১০০ ও ১১০ হলে-
মুদ্রাস্ফীতির হার = (P -P0)/P0✖100 =(১১০-১০০)/১০০ ✖১০০ = ১০০০/১০০ =১০%
মুদ্রাস্ফীতির প্রকারভেদ:
মুদ্রানীতির বিভিন্ন ধারণা
মুদ্রাস্ফীতি বিভিন্ন রকমের হতে পারে। বিভিন্ন দৃষ্টিকোন থেকে মুদ্রাস্ফীতি বিভিন্ন নামে আখ্যায়িত হয়ে থাকে। যেমন-
১। কারণভিত্তিক মুদ্রাস্ফীতি:
ক) চাহিদা
বৃদ্ধিজনিত মুদ্রাস্ফীতি: বাজারের পণ্যসামগ্রী বা সেবার চাহিদা বৃদ্ধির কারণে সৃষ্ট
মুদ্রাস্ফীতিকে চাহিদা বৃদ্ধিজনিত মুদ্রাস্ফীতি বলে। এ সময়ে সামগ্রিক যোগানের চেয়ে
সামগ্রিক কচাহিদা অধিক হারে বাড়তে থাকে।
খ) ব্যয়
বৃদ্ধিজনিত মুদ্রাস্ফীতি: উৎপাদন ও বিপণন ব্যয় বৃদ্ধির কারণে সৃষ্ট মুদ্রাস্ফীতিবে
ব্যয় বৃদ্ধিজনিত মুদ্রাস্ফীতি বলে। এ সময়ে বিভিন্ন কারণে উৎপাদন ব্যয় বাড়ে, সামগ্রিক
যোগান কমে এবং দামস্তর বাড়তে থাকে।
গ) ঘাটতি
ব্যয়জনিত মুদ্রাস্ফীতি: সরকার ঘাটতি ব্যয় নীতি অনুসরণ করলে (কর হার কমানো এবং ব্যয়
বৃদ্ধি) অর্থনীতিতে দামস্তর বৃদ্ধির যে প্রবণতা দেখা োদয় তাকে ঘাটতি ব্যয়জনিত মুদ্রাস্ফীতি
বলে।
ঘ) মুদ্রা
সরবরাহ বৃদ্ধিজনিত মুদ্রাস্ফীতি : অর্থনীতিতে মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধির ফলে দামস্তর
বৃদ্ধির প্রবণতা দেখা দিলে তাকে মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধিজনিত মুদ্রাস্ফীতি বলে।
ঙ) ঋণ
সরবরাহ বৃদ্ধিজনিত মুদ্রাস্ফীতি: উদার ঋণনীতি গ্র্রহণের ফলে অর্থনীতিতে অর্থের
যোগান বাড়ে। এর ফলে বাজারে দামস্তর বাড়লে তাকে ঋণ সরবরাহ বৃদ্ধিজনিত মুদ্রাস্ফীতি বলে।
চ) মজুরি
বৃদ্ধিজনিত মুদ্রাস্ফীতি: বিভিন্ন উৎপাদন ক্ষেত্রে শ্রমিক-কর্মচারীর মজুরি বৃদ্ধির
ফলে সৃষ্ট মুদ্রাস্ফীতিকে মজুরি বৃদ্ধিজনিত মুদ্রাস্ফীতি বলে।
২। গতিভিত্তিক মুদ্রাস্ফীতি:
ক) মৃদু মুদ্রাস্ফীতি: দামস্তর খুব ধীর গতিতে বৃদ্ধি পেতে থাকলে তাকে Creeping
Inflation বা মৃদুগতির মুদ্রাস্ফীতি বলে। এক্ষেত্রে দামস্তর প্রতি বছর ১% থেকে ২% বৃদ্ধি
পায়। এ ধরনের মুদ্রাস্ফীতি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য অনুকূল।
খ) পদসঞ্চারী মূল্যস্ফীতি: এই ক্ষেত্রে, মূল্যস্ফীতির হার ৩% থেকে ১০% এর মধ্যে পড়ে।
এ ধরনের মূল্যস্ফীতি অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। এসময় দাম আরও বাড়ার আশঙ্কায়
ভোক্তারা দ্রব্যসামগ্রী মজুদ করতে শুরু করেন। এটি অতিরিক্ত চাহিদা সৃষ্টি করে এবাং
দাম আরও বৃদ্ধি পায়।
গ) ধাবমান মূল্যস্ফীতি: এই মূল্যস্ফীতি ১০% বা তার বেশি বেড়ে যায় এবং এটি অর্থনীতির
জন্য সম্পূর্ণ বিপর্যয়। এ ধরনের মূল্যস্ফীীততে অর্থ খুব দ্রুত তার মূল্য হারায় এবং
ব্যবসাগুলি খরচ এবং দামের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারে না। বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগে আস্থা
হারায়, সরকার তার বিশ্বাসযোগ্যতা হারায় এবং অর্থনীতি অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে। যে কোনো মূল্যে
এই মূল্যস্ফীতি এড়ানো উচিত।
ঘ) অতি মূল্যস্ফীতি: এটি মূল্যস্ফীতির শেষ পর্যায়ে। এ অবস্থায় মূল্যস্ফীতি সম্পূর্ণ
নিয়ন্তণের বাইরে চলে যায়। মুদ্রা কর্তৃপক্ষের গৃহীত কোনো ব্যবস্থাই দাম নিয়ন্ত্রণ করতে
পারে না। মুদ্যাস্ফীতির হার মাসিক ভিত্তিতে ৫০% হতে পারে। এটি সাধারণত ঘটে যখন সরকার
যুদ্ধের জন্য কাগজের নোট ছাপায়। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর
জার্মানিতে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর হাঙ্গেরিতে এধরনের মূল্যস্ফীতি দেখা গিয়েছে।
৩। নিয়ন্ত্রণের ভিত্তিতে
মুদ্রাস্ফীতি:
ক)
অবাধ মূল্যস্ফীতি: মুদ্রাস্ফীতিকে ‘অবাধ’ বলা হয় যখন কোনো দেশের সরকার ও আর্থিক
কর্তৃপক্ষ জনগণের ব্যয় নিয়ন্ত্রণে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করে না। জনগণ তাদের বর্ধিত আয়
অবাধে ব্যয় করে। ফলে চাহিদা ও দামের তীব্র বৃদ্ধি ঘটে । অর্থাৎ যখন একটি দেশে দামস্তর
বেড়ে যায় এবং যেখানে সরকার বা কোনো কর্তৃপক্ষের দ্বারা দামের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে
না, তখন যে ধরনের মূল্যস্ফীতি সৃষ্টি হয় তাকে অবাধ মূল্যস্ফীতি বলে।
খ)
দমিত মূল্যস্ফীতি: মূল্যস্ফীতি যখন দমন করা হয় অর্থাৎ সরকার এবং আর্থিক কর্তৃপক্ষ
দামকে উচ্চ স্তরে বাড়তে দেয় না, তখন ইটিকে দমিত মূল্যস্ফীতি বলা হয়। বিভিন্ন পদ্ধতির
মাধ্যমে সরকার দ্রব্য ও সেবার দাম নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা গ্রহণ করে। যেমন- মূল্য নিয়ন্ত্রণ,
কিছু পয়োজনীয় দ্রব্যের ক্ষেত্রে রেশনিং ব্যবস্থা, দ্রব্যের সবোর্চ্চ দাম নির্ধারণ,
নির্দিষ্ট সীমার অধিক মুনাফার ওপর কর ধার্যকরণ, বিনিয়োগ ব্যয় নিয়ন্ত্রণ, আমদানির ওপর
উচ্চ কর, ব্যাংকের ঋণ নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি।
৪। কেইনসীয় প্রকারভেদ:
ক)
প্রকৃত মূল্যস্ফীতি: লর্ড কেইনসের মতে,
পূর্ণ কর্মসংস্থানে পৌছানোর পর একটি দেশে যে মূল্যস্ফীতি দেখা যায় তা হচ্ছে প্রকুত
মূল্যস্ফীতি। উৎপাদনের সব উপরকণসমূহ পূর্ণ কর্মসংস্থানে পৌছার পর দ্রব্য ও সেবার উৎপাদন
আর বাড়ানোর সম্ভব নয়। এ অবস্থায় অর্থের যোগান বৃদ্ধি পেলে উৎপাদন বৃদ্ধি না পেয়ে দামস্তর
বাড়তে থাকবে।
খ)
আংশিক মূল্যস্ফীতি: লর্ড কেইনসের মতে, যতক্ষণ অর্থনীতিতে অব্যবহৃত সম্পদ থাকে ততক্ষণ
সাধারণ দামস্তর বাড়ে না। অর্থনীতিতে পূর্ণ কর্মসংস্থানের আগে বিভিন্ন বাধার কারণে যখন
সামগ্রিক ব্যয় বৃদিধ পায়, তখন এ অবস্থা দাম বৃদ্ধির দিকে পরিচালিত করে। এভাবে পূর্ণ
কর্মসংস্থানের আগে যে মূল্যস্ফীতি ঘটে তা আাংশিক মূল্যস্ফীতি হিসেবে পরিচিত।
No comments