'মেঘদূত' কাব্যে বর্ণিত মেঘের যাত্রাপথের একটি ভোগোলিক পরিচয় দাও ।। The journey of the cloud in the poem 'Meghdoot'
'মেঘদূত' কাব্যে কবি কালিদাসের ভৌগোলিক বর্ণনা অপূর্ব কাব্যরসে সিক্ত
কালিদাস সংস্কৃত সাহিত্যের এবং ক্ল্যাসিক রীতির সর্বশ্রেষ্ঠ কবি। কালিদাসের মধ্যে ঐতিহ্যবোধ প্রবল। প্রাচীন ভারতের ঐতিহ্য, ধর্ম সংস্কার, আচার, আভিজাত্য প্রবৃতির পরিচয় মেলে কালিদাসের রচনায়। তাঁর নিপুণ কবি প্রসিদ্ধির জন্য তাঁর রচনাসমূহ সংস্কৃত সাহিত্যের অমর নিদর্শনরূপে বিবেচিত। 'মেঘদূত' কালিদাসের সর্বাপ্রেক্ষা জনপ্রিয় ও সংক্ষিপ্ত কাব্য । ১১৮ শ্লোকে রচিত এই কাব্যটি বহুকাল ধরে পাঠক সমাজে সমাদৃত হয়ে আসছে এ কাব্যের পরিমিতিবোধ ও চিরন্তন মানবিক আকাঙ্ক্ষার জন্য ।
মেঘদূত কাব্যটি দুটি সর্গে বিভক্ত। পূর্বমেঘ ও উত্তরমেঘ। পূর্বমেঘ বহু বিচিত্রের সাথে সৌন্দর্যের পরিচয় এবং উত্তরমেঘ সেই একর সাথে অনন্তের সম্মিলন। পৃথিবীর বহুর মধ্য দিয়ে সেই সুখের যাত্রা এবং স্বর্গলোকে একর মধ্যে সেই অভিসারের পরিণাম। 'মেঘদূত' পাঠে প্রতিটি পর্বে কালিদাস, রচনায় হাত দেবার আগে মনে মনে পুরো কাব্যটির পরিকল্পনা করে নিয়েছিলেন। একেবারে সঠিকভাবে বুঝেছিলেন কী তিনি করতে যাচ্ছেন। কতখানি এই কাব্যের বিস্তার। কী কী প্রসঙ্গ আসবে তার মধ্যে আর সে সব প্রসঙ্গের বিতরণের মাত্রাই বা কেমন হবে। একটি গঠিত সক্ষম নৌকার মতো নিটোল ও নিখুঁত এর গড়ন, কোথাও এতটুকু বাহুল্য বা আতিশয্য নেই, সামগ্রিক পরিকল্পনার মধ্যে প্রতিটি অংশ সুষমভাবে বিধৃত হয়ে আছে।
ভারতের প্রাচীন জনপদ, তীর্থভূমি, গিরি, অরণ্য, নদী, পর্বত, উপত্যকা এসব কিছুকে অঙ্কন করেছেন কবি শৈল্পিক একনিষ্ঠতায়। কাব্যে সমকালীন ভারতের স্থানিক, স্থাপতিক এবং নৈসর্গিক পরিচয়টি প্রাধান্য পেয়েছে। তাঁর রচনা থেকে দুটি বিষয় নিশ্চিতভাবে বলা যায়, কাশ্মীর থেকে দক্ষিণ সাগর পর্যন্ত ভারত ভূমিকে তিনি জানতেন এবং সমগ্র ভারতেরএকটি অখণ্ড ও বাস্তব সত্তাকে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন এবং তাঁর কাল ছিল ঐশ্বর্য ও সম্ভোগে দ্যুতিময়, ইন্দ্রিয় বিলাসে ভরপুর, ছিল বিজয়ী, শক্তিশালী, রাষ্ট্র ও ধর্মের ক্ষেত্রে প্রমিতি সম্পন্ন। তিনি 'মেঘদূত' কাব্যে পূর্বমেঘের যে ভৌগোলিক বর্ণনা দিলেন তা কেবল নীরস ভূগোল নয় তার প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত অপূর্ব কাব্যরসে সিক্ত। এই পথের এবং যক্ষ বর্ণিত নির্দিষ্ট স্থানগুলোর ভৌগোলিক সংস্থানের আলোচনা করলে এটাই স্পষ্ট হবে যে, কালিদাস শুধু ভারতের মহাকবি নন- তিনি একজন প্রধান আবহাওয়াবিদও ছিলেন।
অনেকে মনে করেন যে, 'মেঘদূত' বিরহী যক্ষ হচ্ছেন কবি স্বয়ং। তিনি উজ্জয়িনী প্রবাসে প্রিয়তমার বিচ্ছেদে কাতর হয়ে মিলনাকাঙ্খায় আকুল অন্তর দিয়ে এই অতুলনীয় কাব্যখানি রচনা করেচিলেন। 'মেঘদূতে' মেঘের যাত্রাপথের বিবরণ কবি নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছেন।
পূর্বমেঘের প্রথমেই 'মেঘদূতে'র নায়ক বিরহী যক্ষের পরিচয় পাওয়া যায়। প্রভুর অভিশাপে সে অলকা তেকে রামগিরিতে নির্বাসিত হন। অভিশপ্ত যক্ষ দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে রামগিরি আশ্রমে বসবাস করতে লাগলেন। কিন্তু তার মন পড়ে রইলো সেই সুদূর অলকায় যেখানে তার প্রিয়তমা তার বিরহে একাকিনী বাস করছে। অতি কণ্টে কয়েক মাস কাটাবার পরে আষাঢ়ের প্রথমদিনে পর্বতে বিজড়িত মেঘমালা দেখতে পেয়ে যক্ষ তার বিরহিনী প্রিয়ার কাছে বার্তা প্রেরণ করলো ।
যক্ষের হৃদয়ের বার্তা বহন করে মেঘ নানা দেশ-নদ-নদী-পাহাড়-পর্বত নগরী অতিক্রম করে যাবে অলকাপুরীতে- যেখানে যক্ষপ্রিয়া নিশিদিন বিরহে কাতর। কালিদাসের নির্দিষ্ট মেঘপথের আলোচনা করলে আমরা দেখতে পাই যক্ষ-দূত মেঘের উত্তরগামী পথের আরম্ভ রামগিরি পর্বত থেকে। যক্ষ যাত্রাকালে মেঘকে ঐ তুঙ্গ রামগিরিতে আলিঙ্গন করতে বলেন। রামগিরি ছেড়ে প্রথমেই মেঘ মনোহর মালভূমি আরোহণ করে।যেমন-
"লাঙল পেয়ে হোক সুরভি মালভূমি, তোমার বর্ষণে ধন্য,
এবার লঘূ হয়ে খানিক পশ্চিমে, আবার দিক নাও উত্তর।
যক্ষ মেঘকে আরো জানায় যাত্রাপথ তার নিরানন্দ হবে না। যাত্রাপথে অনেক নয়নাভিরাম দৃশ্য চক্ষুগোচর হবে এবং যাত্রাপথ থাকবে বিভিন্ন ফুলে পরিপূর্ণ। -
"নব কদম্বের সবুজ-পিঙ্গল অর্ধ বিকশিত বর্ণ
দ্যাখে যে মৃগদল, নেয় অরণ্যের মাটির আমোদিত আঘ্রাণ,
এবং মুকুলিত সদ্য ভুঁইচাঁপা জলার ধারে করে ভক্ষণ।"
এবার যাত্রাপথে পড়বে সানুমান আম্রকুট। এর পরেই মেঘকে নর্মদা পার হতে হবে। তারপর মেঘ ক্রমে ক্রমে দর্শাণে উপনীত হবে। এই দর্শাণের রাজধানী বিখ্যাত বিদিশা।
"বিদিশা নাম, সারা ভুবনে বিখ্যাত, যখন যাবে রাজধানীতে,
তখনই পাবে, মেঘ, সকল উপাচারে কামুক বৃত্তির পূর্ণফল।"
বিদিশা বেত্রবতী নদীর উপকূলে অবস্থিত তার উপকণ্ঠে নীচৈঃ গিরি। যক্ষ মেঘকে শ্রম বিনোদনের জন্য এই নীচের পর্বতে বিশ্রাম করার জন্য বলছেন।
"নীচে নামে গিরি সেখানে আছে, তার শিখরে বিশ্রাম নামবে,
তোমার স্পর্শের পুলকে ফোটাবে যে নব কদম্বের গুচ্ছ।"
এরপরেই প্রখ্যাত নদী বেত্রবতী। এর পর মেঘের পথে নির্বিন্ধ্যা তটিনী পার হয়ে উজ্জয়িনী। কালিদাস জানতেন মেঘকে রামগিরি থেকে অলকা যেতে হলে উজ্জয়িনী ঘুরে যেতে হয় না, তবুও উজ্জয়িনীর সৌধ চূড়ায় মেঘকে উপস্থাপিত না করলে কবির মনোবাসনা পূর্ণ হয় না।
"জেনেছো, উত্তরে তোমার অভিযান; যদি বা পথ হয় বক্র,
ভুলো না দেখে নিতে উজ্জয়িনীপুরে সৌধসমূহের উপরিতল;
উজ্জয়িনী শিপ্রা নদতিটে অবস্থিত। উজ্জয়িনী এই শিপ্রার মৃদু বাতাসে শীতলিত আর শিপ্রার সেই স্বচ্ছ জলরাশিতে সে আপন মহিমায় ছায়া দেখতে পায়। উজ্জয়িনী গন্ধবতী তীরে চন্ডীদাসের মহাকালের বিখ্যাত মন্দির। যক্ষ মেঘকে মহাকালের মন্দিরে সন্ধ্যাপূজা কালে ক্ষণিক বিশ্রাম করে নিজের জীবন সফল করার জন্য বলেছেন।
মহাকাল মন্দিরের উত্তরে গম্ভীরা নদী মালবের ক্ষুদ্র একটি তটিনী। পম্ভীরার পর উত্তরগামী পথে দেবগিরি। মেঘকে কবি যাত্রাপথে বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়েছেন।
'সেথায় বাতায়নে কেশের প্রসাধনে গন্ধধূপ উদগীর্ণ,
পুষ্ট তাতে, পাবে প্র্রীতির উপহার, পালিত ময়ূরের মৃত্য;
শ্রান্তি হবে দূর, দ্যাখো এ লক্ষ্মীরে পুষ্পসুরভিত ভবনে।"
দেবগিরি উত্তরে চম্বল নদী। এইবার মেঘ আর উত্তর দিকে অগ্রসর হয়ে ব্রহ্মবর্তে প্রবেশ করবে সেই ব্রহ্মবর্ত দেবনদী স্বরস্বতী ও দূষদ্বতীর অন্তরাদেশ। যক্ষ মেঘকে উপদেশ দিয়েছেন সরস্বতী নদী তীরে অবগাহন করে পাপ বিমোচন করার জন্য। এরপর গম্ভীরা নদী-
বরং গম্ভীরা নদীর অন্তরে প্রবেশ কোরো তুমি, হে সুন্দর
অমল হৃদয়ের মতো সে জলধারা তোমার ছায়ারূপে ধন্য হোক।"
এরপর উত্তরগামী পথে কনখল। কনখল কুরুক্ষেত্রের প্রায় পঞ্চাশ ক্রোশ উত্তর-পূর্বে। এবার তুষার ধবলিত হিমাচল। এই পথ বেয়ে মেঘ ধীরে ধীরে যাবে অলকাপুরীতে।
'ঐ যে হিমাচল, নিকটে কনখল, গা বেয়ে নাম তার গঙ্গা,
জহ্নু-দহিতা সে, সাগর বংশের স্বর্গযাত্রার যেন সোপান"
হিমালয়ের উত্তরে তিব্বত। তিব্বতে যেতে হলে কোন একটি রন্ধ্রপথে প্রবেশ করতে হয়। যকষ যে রণ্ধ্রপথ দিয়ে মেঘকে তিব্বতে প্রবেশ করতে বলেছেন সেই পথের নাম হংসদ্বার (ক্রোঞ্চরন্ধ্র)। যক্ষ বলেছেন নিতিপাস দিয়ে মেঘ তিব্বতে প্রবেশ করে একবারে সরাসরি কৈলাস পর্বতে উপনীত হবে এবং কৈলাসের কুমুদ ধবল শৃঙ্গে বিশ্রাম করবে।
"শিথিল সানু যার রাবণ-বিক্রমে, দ্যুলোক বণিতায় দর্পণ
তুঙ্গতর সেই ধবল কৈলাসে অতিথি হোয়ো তুমি ক্ষণকাল
কৈলাসের দক্ষিণ-পূর্বে বিস্তীর্ণ মানস সরোবর। যক্ষ মেঘের কাছে মানস সরোবরের অপরূপ বর্ণনা দিয়েছেন এবং মেঘকে সেই মানস সরোবরের জল পান করার জন্য অনুরোধ করেছেন। এরপরেই সেই গন্তব্যস্থল সেই যক্ষপ্রিয়ার অলকা-
"কামনার মুখ্য ধাম অলকার মাঝে
বিরহিনী প্রিয়তমা যেথায় বিরাজে।"
সুতরাং উপর্যুক্ত সার্বিক আলোচনা থেকে বলা যায় যে, কবি কালিদাস পূর্ব মেঘের যে ভৌগোলিক বিবরণ দিয়েছেন, সে বিবরণের মূল্র শুধু প্রাচীন ভৌগোলিক তত্ত্বের সন্ধানলাভ হিসেবেই নয়, কাব্যকলার দিক দিয়েও সে এক অমূল্য সম্পদ। কবির এই পূর্ব মেঘের বর্ণনার মধ্য দিয়ে বিভিন্ন নদ-নদী, পাহাড় - পর্বত, দেবালয়, লোকালয়, প্রাকুতিক সৌন্দর্য অদ্যাবধি মানুষের চোখের সামনে চিত্র হয়ে ধরা দেয়- এখানেই মহাকবি কালিদাসের সার্থকতা।
No comments