মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়: বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র ।। Manik Banerjee: A shining star of Bengali literature
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়: বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র
জন্ম ও পরিচয়:
"সাহিত্য সম্রাট" খ্যাত মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, যাঁর প্রকৃত নাম প্রবোধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, ছিলেন একজন বিখ্যাত বাঙালি কথাসাহিত্যিক। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দের ২৯ মে পিতার কর্মস্থল বিহারের সাঁওতাল পরগনার দুমকা শহরে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল ঢাকা জেলার বিক্রমপুরের নিকট মালবদিয়া গ্রামে। তার পিতা হরিহর বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন একজন সরকারি কর্মকর্তা এবং মাতা নিরদাসুন্দরী দেবী ছিলেন গৃহকর্ত্রী।
শিক্ষা ও কর্মজীবন:
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বিভিন্ন স্কুলে পড়াশোনা করেছেন এবং ১৯২৬ সালে মেদিনীপুর জেলা স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি বাঁকুড়া ওয়েসলিয়ান মিশন কলেজে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে ১৯২৮ সালে আই.এস.সি. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
তিনি কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে গণিত বিষয়ে অনার্সে ভর্তি হন। কলেজে থাকাকালীন তিনি "বিচিত্রা" পত্রিকায় "অতসী মামী" নামক তার প্রথম গল্প প্রকাশ করেন। এই গল্পটি পাঠকদের মধ্যে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করে এবং তিনি একজন উদীয়মান লেখক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।
পড়াশোনা শেষ না করেই তিনি লেখালেখির জগতে পূর্ণাঙ্গভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তিনি বিভিন্ন পত্রিকায় সম্পাদক ও সহকারী সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি বিভিন্ন পেশায় কাজ করেছেন, যার মধ্যে রয়েছে শিক্ষকতা, সাংবাদিকতা, এবং প্রকাশনা। তিনি 'কৃত্তিবাস', 'পূর্বাশা', 'উদয়াচল', 'বঙ্গশ্রী' ইত্যাদি পত্রিকায় কাজ করেছেন।
সাহিত্যকর্ম:
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন একজন অসাধারণ প্রতিভাবান লেখক। তিনি তার অসাধারণ সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। তিনি উপন্যাস, ছোটগল্প, নাটক, প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহিনীসহ সাহিত্যের বিভিন্ন বিভাগে অসামান্য অবদান রেখেছেন। আজও তার রচনা পাঠকদের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয়।
উল্লেখযোগ্য রচনা:
- উপন্যাস: দিবারাত্রিক কাব্য, জননী, পুতুলনাচের ইতিকথা, পদ্মানদীর মাঝি, জীবনের জটিলতা, শহরতলি, অহিংসা, চতুষ্কোণ, প্রতিবিম্ব, দর্পণ, চিন্তামণি, চিহ্ন, স্বাধীনতার স্বাদ, সোনার চেয়ে দামী, সার্বজনীন, ফেরিওয়ালা, হরফ, পরাধীন প্রেম, হলুদ নদী সবুজ বন
- ছোটগল্প: অতসী মামী, প্রাগৈতিহাসিক, মিহি ও মোটা কাহিনী, সরীসৃপ, বৌ, সমুদ্রের স্বাদ, ভেজাল, হলুদ পোড়া, আজ কাল পরশুর গল্প, পরিস্থিতি, খতিয়ান, মাটির মাশুল, ছোট বড়, ছোট বকুলপুরের যাত্রী, লাজুকলতা প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
- নাটক: ভিটেমাটি
সাহিত্যিক বৈশিষ্ট্য:
- বাস্তবতাবাদী চিত্রায়ণ: মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন একজন বাস্তববাদী লেখক। তিনি সমাজের নীচুতলার মানুষের জীবনযাত্রা, তাদের দুঃখ-কষ্ট, বেদনা-বেদনার চিত্র অত্যন্ত নিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।
পুরস্কার ও সম্মাননা:
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তার সাহিত্যকর্মের জন্য বেশ কিছু পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল:
- পদ্মভূষণ (১৯৫৫)
- সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার (১৯৫৫) - "পদ্মানদীর মাঝি" উপন্যাসের জন্য
- রবীন্দ্র পুরস্কার (১৯৫৮) - মরণোত্তর
ব্যক্তিজীবন:
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন একজন অত্যন্ত আবেগপ্রবণ ব্যক্তি। তিনি তীব্র জীবনবোধে অনুপ্রাণিত ছিলেন এবং জীবনের প্রতি তার ছিল অসীম মোহ। তিনি বিভিন্ন সমাজের মানুষের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন এবং তাদের জীবন সম্পর্কে জানতে আগ্রহী ছিলেন।
রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড:
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন একজন প্রগতিশীল চিন্তাবিদ এবং বামপন্থী রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন। তিনি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সাথে যুক্ত ছিলেন এবং ব্রিটিশ শাসনামলে স্বাধীনতা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় জীবনের প্রথম পর্বে মনোবিজ্ঞানী ফ্রয়েড, ইয়ুং, অ্যাডলার প্রমুখ দ্বারা প্রভাবিত হলেও পরবর্তী সময়ে তিনি মার্কসবাদে দীক্ষা নেন। ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় সদস্য হন এবং আমৃত্যু এই দলের কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ফ্যাসিবাদবিরোধী লেখক ও শিল্পী সঙ্ঘের সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন। সাহিত্যের মাধ্যমে মার্ক্সের শ্রেণিসংগ্রামতত্ত্বের বিশ্লেষণ এবং মানুষের মনোরহস্যের জটিলতা উন্মোচনে তিনি ছিলেন একজন দক্ষশিল্পী।
মৃত্যু:
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ৩রা নভেম্বর, ১৯৫৬ সালে মাত্র ৪৮ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
উপসংহার:
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন বাংলা সাহিত্যের একজন দিকপাল। তিনি তার অসামান্য রচনার মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন এবং বাংলা উপন্যাসের ধারাকে এক নতুন মাত্রায় উন্নীত করেছেন। তিনি আজও বাংলা সাহিত্যের পাঠকদের কাছে একজন জনপ্রিয় লেখক এবং তার লেখার প্রাসঙ্গিকতা আজও অম্লান।
No comments