Header ads

ট্র্যাজেডি হিসেবে ‘ইডিপাস’ নাটকের সাফল্য ও সার্থকতা বিচার কর। Success of 'Oedipus' as Tragedy

ট্র্যাজেডি হিসেবে ‘ইডিপাস’ নাটকের সাফল্য ও সার্থকতা বিচার কর। Success of 'Oedipus' as Tragedy
 ট্র্যাজেডি হিসেবে ‘ইডিপাস’ নাটকের সাফল্য ও সার্থকতা বিচার কর।

 থিবিসের  গাঁথা অবলম্বনে গ্রীক নাট্যকার সফোক্লিস (খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতক) ‘রাজা ইডিপাস’ নাটকটি রচনা করেছেন। গ্রিক ট্র্যাজেডির স্বরূপ আমরা এ নাটকের মাধ্যমে জানতে পারি। এতে আত্মদ্বন্দ্বে পর্যুদস্ত মানবাত্মার সকরুণ বেদনা ও সুকঠোর পীড়নের চিত্র উদঘাটিত হয়েছে। নায়ক ইডিপাসের অসীম দুঃখভোগ ও নিদারুণ বেদনা সহৃদয় পাঠকের প্রাণকে বিমথিত করে তোলে।

        গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটল তাঁর ‘পোয়েটিকস’ গ্রন্থে ট্র্যাজেডির সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে গিয়ে বলেছেন, “ট্র্যাজেডি হলো গভীর মনোনিবেশ দাবি করে এমন ঘটনার একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্রিয়ার প্রতিফলন যা নিজেই সম্পূর্ণ এবং কিছুটা প্রশস্ত, যার ভাষা নাটকের বিভিন্ন অংশের উপযোগী বিচিত্র শৈল্পিক অলংকরণে সমৃদ্ধ, যা আখ্যানরূপে নয়, নাটকের আকারে উপস্থাপিত হয়, যা করুণা ও ভয় জাগিয়ে এসব অনুভূতিকে পরিশুদ্ধি ঘটায়।“

        এরিস্টটলের এ সংজ্ঞা অনুসারে যথাযথভাবে পরীক্ষা করলে দেখা যায়, নাট্যকার সফোক্লিসের ইডিপাস হচ্ছে গ্রিক ভাষার মহত্তম ট্র্যাজেডি। এর নায়ক ইডিপাস দোষেগুণে সাধারণ মানুষ। তিনি অশেষ প্রতিপত্তিশালী হলেও সাধারণ মানুষ সুলভ ক্রুটিবিচ্যুতির উর্ধ্বে নন। সমালোচকের ভাষায়, “তাঁর (ইডিপাস) দৃষ্টি কখনো তীক্ষ্ণ, কখনো অস্বচ্ছ এবং দৃষ্টির একাগ্রতা সত্ত্বেও সে কোন বিশেষ একটা দিক মাত্র দেখতে সমর্থ হয়- যা তার পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকর। ইডিপাসকে বলা যায়, ‘A man of no exceptional faults or virtues’ দোষত্রুটি, ভুল-বিচ্যুতি, ভালোমন্দ মেশানো একজন সাধারণ মানুষ। সে স্বর্গলোকের দেবতাও নয়, আবার পাতালপুরীর দানবও নয়”। [মোবাশ্বের আলী: বিশ্বসাহিত্য]

        ইডিপাস এমনি এক জীবন্ত চরিত্র, যিনি সাধারণ হয়েও অসাধারণ মহিমায় দেদীপ্যমান। থিবিস নাগরিকদের গভীর আনুগত্য ও একনিষ্ঠ শ্রদ্ধা তাঁর প্রতি। একদা ইডিপাস তাদের মহামারি স্ফিংসের প্রহেলিকা থেকে রক্ষা করেছিলেন। তাই দেশের চরম দুর্ভোগে তারা আবার এসছে ইডিপাসের কাছে, এসেছে মুক্তির আশায়। রাজার দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন ইডিপাস দেশকে বিপদমুক্ত এবং প্রজার শান্তি ও নিরাপত্তা বিধানে তৎপর হয়েছেন। শ্যালক ক্রীয়নকে দেবতার মন্দিরে পাঠিয়ে অভিশাপের কারণ অনুসন্ধান করেছেন। যখন দৈববাণীতে বলা হলো, ভূতপূর্ব রাজা লেয়াসের হত্যাকরী শাস্তিবিধান করা হলে রাজ্য পাপ ও কলঙ্কমুক্ত হবে, তখন ইডিপাস হত্যাকরীকে খজেঁ বের করতে তার সমস্ত প্রচেষ্টা নিয়োজিত করেছেন, "আমি নতুন করে সন্ধান করব। সমস্ত কিছু দিবালোকের মতো উদ্ভাসিত হবে।… দেবতার জন্য এবং আমাদের দেশের জন্য আমি তোমাদের সহায়ক বন্ধু হিসেবে কাজ করবো। এ কলঙ্কিত হত্যার প্রতিশোধ আমি নেব”।

        যে গুরুদায়িত্ব তার প্রতি ন্যস্ত হয়েছে তা তিনি সুষ্ঠুরূপে সম্পাদন করতে ব্রতী হয়েছেন। টেরিসিয়াসের অভিশাপ ও সাবধান বাণী, রাণী জোকাস্টার অনুরোধ কিছুই তাকে নিবৃত্ত করতে পারে নি। আর এ হত্যারহস্য উন্মোচন করতে গিয়ে ইডিপাসের কাছে উদঘাটিত হলো জন্ম ও জীবনের নিষ্ঠুরতম সত্য। ভাগ্যের অভিশপ্ত সন্তান ইডিপাস আপন পিতার হত্যাকারী এবং আপন মাতার শয্যাসঙ্গী। এ মস্তবড় পাপের শাস্তি ইডিপাস এড়ালেন না এই বলে যে, সজ্ঞানে পাপ করেননি, বরং স্বেচ্ছায় তা বরণ করে নিলেন। আত্মহত্যায় মৃত রাণী জোকাস্টার গাত্রাবরণ থেকে কাঁটা খুলে নিয়ে ইডিপাস নিজেই নিজের চক্ষু উৎপাটিত করলেন। ইডিপাসের এ নিঃসীম দুঃখভোগ ও মর্মান্তিক পরিণতি দেখে আমাদের প্রাণ বেদনায় ব্যথিত হয়। অন্ধ ইডিপাস যখন বলেছেন, “এ কি অনন্ত রাত্রি- আর কখনো দিন আসবে না! আশ্চর্য ঘন মেঘ, কোনও বাতাস যা উড়িয়ে নিতে পারবে না। আত্মার অন্ধকার স্মৃতি – আমি লাঞ্ছিত নিপীড়িত ও মুহ্যমান”। তখন তাঁর নিদারুণ বেদনা ট্র্যাজিক হয়ে ওঠেছে। মৃত্যু তো ট্র্যাজিক নয়, মৃত্যুর অনুভূতি ট্র্যাজিক। যে কোন আকস্মিক দুর্ঘটনায় মুহূর্তের মধ্যে মৃত্যু সংঘটিত হতে পারে। কিন্তু তা কখনো ট্র্যাজিক মর্যাদা লাভ করে না। মৃত্যুর সুগভীর অনুভূতি, যা তিলে তিলে দগ্ধ করে, তাই তো সত্যিকারের ট্র্যাজেডি।

ইডিপাস শুধু মৃত্যুকে প্রত্যক্ষ করেননি, মৃত্যুকে অনুভব ও উপলব্ধি করেছেন, তাই তো বলেছেন, “…. শৈশবে আমার পিতামাতা সিথায়েরন পর্বতে আমার মৃত্যু চেয়েছিলেন, তাদেঁর আকাঙ্ক্ষা আমি পূর্ণ করবো। আমি সেখানে মৃত্যূর জন্য অপেক্ষা করবো”। পাপের শাস্তি গ্রহন ও স্বীকার করার মধ্যে এবং অনুভূতির তীব্রতা ও তীক্ষ্ণতায় ইডিপাস আপনাকে আপনি অতিক্রম করে গেছেন। তাঁর অতল গভীর বেদনা ট্র্যাজিক মহিমা লাভ করেছে।

ইডিপাসের নিদারুণ বেদনা আমাদের মনকে ছুয়েঁ যায়। ইডিপাস তাঁর অসহায় কন্যাদের কথা ভেবে যখন ব্যাকুল হন তখন তাঁর বেদনায় আমরা সমব্যথী হই। “ আমার মেয়েরা? আমাকে ছাড়া তারা কি করে বাঁচবে। ক্রীয়ন, ওদের লক্ষ্য রেখ?... যদি একবার ওদের স্পর্শ করতে পারতাম, কাঁদতে পারতাম”। কিংবা ইজনীনি ও এন্টিগনী ইডিপাসের সম্মুখে এসে দাঁড়ালে তিনি বিহ্বল হয়ে বলেছেন, “তোমরা বড় হলে বুঝবে কেন আমি আমার পৃথিবীকে অন্ধকার করেছিলাম। বড় হয়ে প্রার্থনা কর শান্তি ও নিশ্চিন্তায় জীবন কাটুক। আমার অকল্যাণ যেন তোমাদের স্পর্শ না করে”।

‘ইডিপাস’ নাটকে নায়ক ইডিপাসের অভিজ্ঞান এবং পরিস্থিতি বিপর্যয়ের ফলে আমাদের চিত্তে শুধু ভীতি ও করুণা নয়, বিস্ময়বোধও সঞ্চারিত হয়ে থাকে। এ কারণেই এরিস্টটল ‘ইডিপাস’কে Perfect ট্র্যাজেডি বলে অভিহিত করেছেন। এটি জটিল ট্র্যাজিডিও বটে। কারণ এতে Reversal of situation, Discovery এবং The scene of suffering রয়েছে। এর ফলে ট্র্যাজেডির আখ্যান জটিল হয়ে উঠেছে। ইডিপাস নাটকের শেষাংশে ইডিপাসের Disaster বা Suffering দেখে শুধূ নয়, শুনেই আমরা ভয়ে শিহরিত এবং করুণায় বিগলিত হই। ইডিপাস আপন হৃদয়বলে, মনোবলে ও সহনশক্তিবলে নিয়তিকে গ্রহণ করার ও স্বীকার করার তাঁর প্রচেষ্টা দেখে আমরা আশ্বস্ত হই। ইডিপাস আমাদের কাছে হয়ে উঠে মহিমান্বিত ট্র্যাজেডির নায়ক।

উপর্যুক্ত কারণেই সফোক্লিসের ‘ইডিপাস’কে বলা হয় ধ্রুপদী ট্র্যাজেডির শ্রেষ্ঠ নমুনা। এটি সার্থক গ্রিক ট্র্যাজেডি নাটক হিসেবে সকলের কাছে সমাদৃত হয়েছে। এতে মানুষের আকাঙ্ক্ষার ও ঘটনার গভীরে প্রবেশ করার অন্তর্দৃষ্টির সাথে নিখুঁতভাবে একটি কাহিনিকে প্রথিত করা হয়েছে। একজন সাধারণ মানুষের উপর দুভার্গ্য নেমে আসার ফলে যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে তারই কাহিনি এটি। এতে দুঃখ, বেদনা, শঙ্কা রয়েছে। বিশ্ববিধান বিচলিত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা যায়, তবে শেষ পর্যন্ত সেই চরম বিপর্যয়কে প্রতিহত করা হয়েছে। তাই ‘ইডিপাস’কে নিখুঁত ট্র্যাজেডি রূপে অভিহিত করা যায়। 




No comments

Theme images by Maliketh. Powered by Blogger.