Header ads

লাহোর প্রস্তাবের পটভূমি কী ছিল? অথবা, লাহোর প্রস্তাবের কারণগুলো আলোচনা করো।

লাহোর প্রস্তাবের পটভূমি কী ছিল? অথবা, লাহোর প্রস্তাবের কারণগুলো আলোচনা করো। Background of the Lahore Resolution

লাহোর প্রস্তাবের পটভূমি কী ছিল? অথবা, লাহোর প্রস্তাবের কারণগুলো আলোচনা করো। 

    ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে লাহোর প্রস্তাব একটি ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ মুসলিম লীগের লাহোর অধিবেশনে ভারতের উত্তর-পশ্চিম ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলসমূতে একাধিক স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়, যা "লাহোর প্রস্তাব" নামে পরিচিত। এ প্রস্তাবেকে ভারতীয় সমস্যা সমাধানের জন্য মুসলিম লীগের প্রথম গঠনমূলক প্রস্তাব বলা যায়। যদিও পরবর্তীতে এ প্রস্তাব বিকৃত করে "পাকিস্তান প্রস্তাব" হিসেবে রূপ দেওয়া হয়, যার অনিবার্য পরিণতিতে ১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টি হয়। 

১.    স্যার সৈয়দ আহমদ খানের ভূমিকাঃ উত্তর ভারতের প্রখ্যাত মুসলিম চিন্তাবিদ স্যার সৈয়দ আহমদ খান উনবিংশ শতাব্দীল শুরুর দিকে মুসলমানদের মধ্যে সর্বপ্রথম বিচ্ছিন্নতাবাদের বীজ বপন করেন। তিনিই প্রথম ঘোষণা করেন, ভারতে দুটি ভিন্ন জাতি বসবাস করে। সম্প্রদায় ভিত্তিক জাতীয়তাবাদ উদ্ভব এখান থেকেই শুরু। যে কারনে তিনি হিন্দু প্রভাবিত কংগ্রেসে মুসলমানদের যোগ দিতে বারণ করেন। 

২.     ব্রিটিশ সরকারের ভূমিকাঃ ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই মুসলমানরা নিজেদেরকে পৃথক জাতি হিসেবে ভাবতে থাকেন। কারণ ব্রিটিশ সরকার তাদের শাসনকালের শুরুর দিক হতে "ভাগ কর, শাসন কর" নীতি গ্রহণ করে। ফলে হিন্দুরা সবদিক থেকে এগিয়ে যায় যেটা মুসলমানদের মধ্যে আপেক্ষিক শোষনের ধারণাকে দৃঢ় করে। হিন্দু আধিপত্য থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য মুসলমানরা লাহোর প্রস্তাব উত্থাপন করে। 

৩.    লক্ষৌ চুক্তি ও জিন্নাহর চৌদ্দ দফা: প্রথম মহাযুদ্ধের সময় হতে মুসলমারনা পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থার দাবি করে আসছিল। তাদের এ দাবির প্রেক্ষাপটে ১৯১৬ সালে লক্ষৌ চুক্তি ও ১৯২৯ সালের জিন্নাহর চৌদ্দ দফা গৃহীত হয়। প্রথম মহাযুদ্ধের পর উলামা সম্প্রদায় রাজনীতিতে প্রভাব মুসলমানদের বিচ্ছিন্নতাকে আরো জোরদার করে তোলে। 

৪.    ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদঃ লর্ড কার্জন ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের সৃষ্টি করে। এতে করে মুসলমানদের ভাগ্যে সুবাতাস বইতে শুরু করে। কিন্তু হিন্দুগণ এটা তাদের স্বার্থের পরিপন্থি মনে করে তীব্র আন্দোলন শুরু করে। ফলে তাদের তীব্র আন্দোলনের মুখে ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হয়। এতে করে মুসলমানরা হতাশ হয় এবং পৃথক রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখে, যা স্পষ্ট হয়েছে লাহোর প্রস্তাবে। 

৫.    ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনঃ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯২৯ সাল থেকে ১৯৩৫ সালের সর্বভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে চিরদিনের ন্যায় অগ্রহণযোগ্য ঘোষণা করেন এবং এক শাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। যার ফলে ভারতীয় মুসলমানরা স্বীয় সংস্কৃতি ও জীবনধারাকে অব্যাহত রেখে ভারতের বুকে মর্যাদার সাথে বসবাস করতে সক্ষম হবে। কিন্তু এ আইন ভারতীয় জনসাধারণের আশা-আকাঙ্খা পূরণে ব্যর্থ হয়। 

৬.    ১৯৩৭ সালের নির্বাচনঃ ১৯৩৫ সালের শাসন আইন অনুয়ায়ী ১৯৩৭ সালে নির্বাচন হলে তাতে কংগ্রেস জয়লাভ করে। জয়লাভ করার পর দলটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বন্দে মাতরাম গান গাওয়ার ব্যবস্থা করে এ্বং রাষ্ট্রভাষা হিসেবে হিন্দিকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা চালায়। ফলে তৈরি হয় লাহোর প্রস্তাবের ক্ষেত্র। 

৭.    নেহেরু রিপোর্টের প্রতিক্রিয়াঃ ব্রিটিশ ভারতের শাসনতান্ত্রিক বিধানের অগ্রগতির ইতিহাসে নেহেরু রিপোর্ট এক গুরুত্বপূর্ণ দলিল। সকল রাজনৈতিক দল ও সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি নিয়ে ব্রিটিশ ভারতের সাংবিধানিক সমস্যা সমাধানের পরিকল্পনা গ্রহণ করার জন্য ১৯২৮ সালে নেহেরু কমিটি গঠিত হয়। কমিটি লক্ষ্মৌ চুক্তিতে মুসলমানদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি সংরক্ষণের জন্য গৃহিত ভ্যবস্থাদি অস্বীকার করে। ফলে ভারতীয় মুসলিম নেতাদের মধ্যে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তাধারার পরিবর্তন দেখা যায়। 

৮.    গোলটেবিল বৈঠকের ব্যর্থতাঃ ভারতীয় উপমহাদেশের জনগণের মধ্যে চরম উত্তেজনা প্রশমন এবং হিন্দু-মুসলমান সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে লন্ডনে ব্রিটিশ সরকার, ভারতীয় বিভিন্ন দল, সম্প্রদায় ও দেশীয় রাজ্যের প্রতিনিধিদের নিয়ে ১৯৩৯ সালে গোল টেবিল বৈঠকের আয়োজন করা হয়। কংগ্রেস কর্তৃক মুসলমানদের নূণ্যতম দাবি মেনে না নেওয়ার কারনে কংগ্রেস সম্পর্কে মুসলিম লীগের মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়। যার ফলশ্রুতিতে মুসলিম লীগ পৃথক আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার দিকে ঝুকেঁ পড়ে। উপস্থাপিত হয় লাহোর প্রস্তাব। 

৯.    হিন্দু জতীয়তাবাদীদের প্রভাবঃ ভারতীয় উপমহাদেশের রাজণিততে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প আরো জলীভূত হয় যখন কংগ্রেস সভাপতি পণ্ডিত জওহর লাল নেহেরু মুসলিম দলকে অস্বীকার করে মন্তব্য করেন যে, "ভারতে দুটি শক্তির অস্তিত্ব লক্ষনীয়, একটি সরকার এবং অপরটি কংগ্রেস দল। তাদের ও মনোভাব মুসলমান নেতাদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এতে ভারতীয় রাজনীতিতে হিন্দু - মুসলিম মিলনের প্রবক্তা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ মুসলমানদের জন্য পৃথক রাষ্ট্রের চিন্তা করেন। 

১০.    মুসলিম চিন্তাবিদদের প্রাগ্রসর চিন্তাধারাঃ লাহোর প্রস্তাবে যে স্বাধীন মুসলিম আবাসভূমির দাবি করা হয়েছে, -অনুরূপ একটি প্রস্তাব ১৯৩০ সালে মহাকবি আল্লামা ইকবাল এলাহাবাদ তাঁর একটি ভাষণে উল্লেখ করেন। তিন বছর পর ১৯৩৩ সালে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র চৌধুরী রহমত আলী ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ ৫টি মুসলিম এলাকার জন্য "পাকিস্তান" নামের উদ্ভাবন করেন। এরূপ আরো কয়েকটি প্রস্তাবে পৃথক রাষ্ট্র গঠনের মাধ্যমে হিন্দু-মুসলিম সমস্যা সমাধানের কথা বলা হয়। 

    পরিশেষে বলা যায় যে, লাহোর প্রস্তাব দীর্ঘদিনের চিন্তাভাবনার এক ফসল। এর শাধ্যমে হিন্দু-মুসলিম সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে মুসলমানদের জন্য একটি পৃথক মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। মুসলমানদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র গঠনের ক্ষেত্রে এটা ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। 

No comments

Theme images by Maliketh. Powered by Blogger.